পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে। টেকসই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য করোনা মহামারীর মধ্যেও গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। এই সবুজ বিনিয়োগ এখন শুধু তৈরি পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ নেই। তৈরি পোশাক খাতের বাইরে প্লাস্টিক, হালকা প্রকৌশল খাতেও সবুজ বিনিয়োগ বাড়ছে। এ খাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সবুজ শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ এখনো অনেক কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১১ সালে বাংলাদেশ গ্রিন ব্যাংকিং নীতিমালা করলেও তা এখনো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি ব্যাংকগুলোর কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, সবুজ অর্থায়ন করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সবুজ অর্থায়নে শীর্ষে রয়েছে বিদেশি মালিকানার এইচএসবিসি ব্যাংক। ব্যাংকটি এ খাতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রণী ব্যাংক বিতরণ করেছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইসলামী ব্যাংকও এ খাতে ঋণ দিয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক মিলে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সবুজ শিল্পে। এর বাইরে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ১২২ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক গ্রিন ব্যাংকিংয়ের আওতায় ঋণ দিয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোরও এ খাতে বিনিয়োগে আসা উচিত বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেননা এখন বিশ্বব্যাপীই তুলনামূলক কম কার্বন নিঃসরণ করে পরিবেশকে রক্ষা করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই পৃথিবীবাসীর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের ফ্যাকাল্টি মেম্বার মোহাম্মদ আমান উল্লাহ আমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দিন যত যাচ্ছে পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশটা ততই চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে। এটার জন্য মানুষই দায়ী। আমরা আমাদের পরিবেশকে নষ্ট করে ফেলছি। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানছি না। তাই আমাদের পরিবেশ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা শিল্পকারখানা করছেন। কিন্তু এটাতে মানুষ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা ভাবছেন না। যারা সেখানে কাজ করবেন, তাদের কাজের সুন্দর পরিবেশের কথাও ভাবছেন না। অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে তোলার ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, যার ফলে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। জীবনকে করে তুলছে অতিষ্ঠ। তাই নিজেদের বাঁচাতে, পরিবেশকে বাঁচাতে সবুজ কারখানা করার আহ্বান জানান। সবুজ কারখানায় পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে।
এদিকে সম্প্রতি টঙ্গীর মাজুখানে স্থাপিত এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড নামের একটি প্লাস্টিক ও মেটাল কারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ছয় তলা ভবনের চারপাশেই বিভিন্ন রকম গাছগাছালিতে ঘেরা। দৃষ্টিনন্দন এই ভবনের বেলকনি ও ছাদও গাছগাছালিতে ভরা। ভবনের দুই পাশে বড় বড় জানালা। এক পাশে জানালার ওপরে বড় বড় অ্যাডজাস্ট ফ্যান ঘুরছে। উল্টো পাশ থেকে বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস ঢুকছে। প্রতি ২০ সেকেন্ড পর পর অ্যাডজাস্ট ফ্যানের মাধ্যমে ভিতরের গরম বাতাস বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে। ওপর-নিচ মিলিয়ে চারটি ফ্লোরে কাজ করছেন ছয় শতাধিক শ্রমিক। কারও গায়েই কোনো ঘামের দুর্গন্ধ নেই। কারখানার ভিতরে নেই সামান্যতম গরম। অথচ ভিতরে কোনো এয়ারকন্ডিশনার বা সিলিং ফ্যানও নেই। এমনকি গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত প্রায় সারা বছরই কারখানার ভিতরে একই রকম তাপমাত্রা অনুভূত করে। তবে কুয়াশা ঘেরা শীতের সকালে কিছুটা বেশি ঠান্ডা থাকে। বাইরের পরিবেশ অত্যন্ত ছিমছাম, মনোরম। সিলিংয়ের অংশে বড় বড় স্বয়ংক্রিয় পানির লাইন, অগ্নি দুর্ঘটনা এড়ানোর পাইপ বসানো। দরজা-জানালাগুলো এতটাই প্রশস্ত যে কারখানার ভিতরে অনাকাক্সিক্ষত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও শ্রমিকরা খুব সহজেই কোনো রকম হুড়োহুড়ি ছাড়াই বাইরে বেরুতে পারবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিই হতে পারে অন্যদের জন্য সবুজ কারখানা গড়ে তোলার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এ প্রসঙ্গে এক্সক্লুসিভ ক্যান ও কিউ পেইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির বলেন, টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে সবুজ শিল্পায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ব্যবসায়িক দিক দেখলেই হবে না। পরিবেশের কথাও ভাবতে হবে। সে কথা মাথায় রেখেই আমি আমার কারখানাটি গড়ে তুলেছি। তবে এ খাতে সরকারের নীতিগত সহায়তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরেও যে গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে, সেগুলোর দিকেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নজর দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) নামের একটি সংস্থা সারা বিশ্বের সবুজ শিল্পের সনদ দিয়ে থাকে। এই সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি সবুজ কারখানার ৩৯টি বাংলাদেশে স্থাপিত। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫০টি সবুজ কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে ৪১টিই সবুজ কারখানা হিসেবে প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়েছিল নয় তলা ভবন রানা প্লাজা। এটি ছিল দেশের পোশাক শিল্পে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ভবন ধসে প্রাণ হারান হাজারেরও বেশি মানুষ। যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন, তারাও পঙ্গুত্ব নিয়ে কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন। রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপরই বাংলাদেশে সবুজ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। প্রায় আট বছরে দেড় শতাধিক সবুজ কারখানা গড়ে উঠেছে। যা ইউএসজিবিসি থেকে স্বীকৃত। এর বাইরে আরও অন্তত ৫০০টি সবুজ কারখানা গড়ে উঠেছে। যারা সনদের অপেক্ষায়।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ ব্যাংকার বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুর রহমান বলেন, সবুজ শিল্পের প্রসার ছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা কঠিন। এ জন্য সারা বিশ্বই এখন গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট ও সাসটেইনেবল বিজনেসের দিকে ঝুঁকছে। আমাদেরও সময় এসেছে গ্রিন ব্যাংকিংকে গুরুত্ব দেওয়ার। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী মানুষের জন্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।