নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা থেকে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ৩ কোটি টাকার চাঁদা উঠছে। পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীসহ পেশাদার চাঁদাবাজদের আসকারায় এরই মধ্যে নিষিদ্ধ এ যানবাহনে সয়লাব হয়ে পড়েছে ঢাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেই, বরং দিন দিন এগুলোর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে যানজট, ভোগান্তি। রাজধানীতে অবৈধভাবে চলাচলকারী প্রায় ১ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে হরদম। এ যেন অফুরন্ত চাঁদা- যে যেভাবে পারছে সেভাবেই হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যাটারিচালিত অবৈধ যানের টাকা। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, থ্রি হুইলার থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয় মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, বাড্ডা, ফার্মগেট, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, জুরাইন রেল গেট, নিউমার্কেট, আজিমপুর, নিউ পল্টন, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর মাজার রোড, উত্তরখান ও উত্তরা এলাকায়। জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা রুটে চলাচলকারী একেকটি লেগুনা থ্রি হুইলার থেকে প্রতিদিন ৪০০ টাকা হারে অন্তত ৩ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত ইজিবাইক চলাচলের ক্ষেত্রে রাজধানীর বিমানবন্দর, উত্তরখান ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকাজুড়ে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। সেখানে প্রতি গাড়ির প্রতিটি ট্রিপ থেকেই নানা অজুহাতে এবং থানা পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি চলছে। প্রতিদিন সেখানে প্রায় ৮ হাজার অবৈধ যানবাহন থেকে ১৬ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী চালকরা জানান, টাকা দিলে সব ঠিক আর না দিলে পুলিশের ফর্মা ও কনস্টেবল মিলে গাড়িচালক, হেলপারদের ধরে নিয়ে মারধর করে। বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে সোর্স মানিক, কাল্লু, আনসার সদস্য বেলালসহ ৮/১০ জনের একটি গ্রুপ এই বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। উত্তরবাড্ডা থেকে সাতারকুল রোডে চলাচলকারী শত শত অটো গাড়ির চাঁদা পকেটস্থ করছে তাহেরপুত্র অনিক, লাইনম্যান রহিম, মোজাম্মেলসহ ৭/৮ জনের একটি চক্র। ওই রোডের বিভিন্ন পয়েন্টে ক্লাব ও সমিতির সাইনবোর্ড ঝুলিয়েও বিভিন্ন বখাটে গ্রুপ হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে বাড্ডা সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনার একাধিকবার পদক্ষেপ নিয়েও চাঁদাবাজদের দাপটের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। আদর্শনগরের বড়টেক সংঘ ক্লাবের নামে, স্বাধীনতা সরণিতে ঢাকা মহানগর ক্লাব নামে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সর্বত্রই মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে অবৈধ এ যান চলাচলের মৌখিক বৈধতা দিচ্ছে পুলিশ। কোনো কোনো এলাকায় প্রতিদিন নামানো হচ্ছে ৪০/৫০টি নতুন অটো-ইজিবাইক। প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে নিত্যনতুন রুট বানিয়ে শত শত নিষিদ্ধ যানের বিস্তৃতি গড়ে তোলা হচ্ছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, কদমতলী থানার দনিয়া এলাকায় মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা নামিয়েছে চোরাই সিন্ডিকেট। এরা নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা থেকে অটোরিকশা চুরি করে এনে দনিয়া এলাকার বিভিন্ন রিকশার গ্যারেজে রাখে এবং পরবর্তীতে সেগুলোর রং পরিবর্তন করে ব্যাটারি লাগিয়ে রাস্তায় নামায়। চক্রটি ডাম্পিং স্টেশন থেকেও নানা কৌশলে অটোরিকশা এনে রাস্তায় ছাড়ে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর দক্ষিণখান ও উত্তরখানের চারটি রুটেই চলাচল করছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এ রুটগুলো হচ্ছে- বিমানবন্দর রেললাইন থেকে দক্ষিণখান, তালতলা, কসাইবাড়ী, হাজী ক্যাম্প হতে কাঁচকুড়া এবং আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরখান মাজার রোডসহ অন্যান্য পয়েন্ট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ এলাকার প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন ১২০ টাকা করে চাঁদা আদায় হয়। সংঘবদ্ধ একটি চক্রের সদস্যরা এসব চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদার টাকা থেকে থানা পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান-সন্ত্রাসী, ট্রাফিক বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। চাঁদার টাকা না দিলে লাইনম্যান, ট্রাফিক পুলিশ ও থানা পুলিশ সেসব গাড়ি আটক করাসহ সংশ্লিষ্ট চালকদের ওপর নির্যাতন চালানোর ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকে। উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরস্থ আবহাওয়া কোয়ার্টারের সামনে আওয়ামী লীগের এক নেতার নেতৃত্বে তিন শতাধিক ইজিবাইকের নিয়ন্ত্রণ করছে দুজন লাইনম্যান। যার প্রতিটি থেকে দৈনিক ১৩০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রতিটি অটো থেকে হাউসবিল্ডিং এলাকায় ২০০ টাকা ও দিয়াবাড়ী এলাকায় ১২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। চাঁদা তোলার দায়িত্বে লাইনম্যান হিসেবে রয়েছে ৭/৮ জন। স্থানীয়রা জানান, আজমপুরের পূর্ব পাশের ইজিবাইক স্ট্যান্ডের পাঁচ শতাধিক গাড়ি থেকে দৈনিক ১০০/১২০ টাকা করে আদায় করছে ১০ জন লাইনম্যান। এ স্থানে ইজিবাইক এমনভাবে রাস্তা দখল করে থাকে যে কারণে প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণকে চলার পথে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়াও বিমানবন্দর ট্রাফিক পুলিশ বক্সের এক কর্মকর্তা প্রতি সপ্তাহে অটো প্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা করে আদায় করে নিচ্ছে। মাসোহারার টাকা না পেলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ইজিবাইক পুলিশ বক্সে আটকে রেখে ডাম্পিং ও রেকার বাণিজ্য করেন। ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত অটো ও লেগুনা নামের নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে খিলক্ষেত এলাকায়। সেখানে রেলগেট মোড় থেকে ১২ শতাধিক অবৈধ যান চলাচল করছে অবাধে। সেখানেও পুলিশের হয়ে কাজ করে ‘লাইনম্যান’ নামে স্থানীয় একটি চক্র। ব্যাটারিচালিত এসব অবৈধ অটো থেকে প্রতিদিন আড়াই লক্ষাধিক টাকা চাঁদাবাজি চলে। পল্লবী ও রূপনগর থানা এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত অটো রিকশাগুলো থেকে কয়েক বছর ধরেই চাঁদা আদায় করেন স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা। প্রতি মাসে সেখানে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি ঘটে থাকে। চাঁদার টাকা থানা পুলিশ, ট্রাফিক বিভাগ, নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সেক্টরে পৌঁছে দেওয়ার পরও প্রতি মাসে আশি লক্ষাধিক টাকা ওই যুবলীগ নেতার পকেটে ঢোকে বলে জানা গেছে। তবে গত জুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর ঘোষণার পরপরই মিরপুরজুড়ে শুরু হয় আরেক নির্মমতা। সেখানে অটোরিকশা দেখামাত্র পুলিশ ধাওয়া করে সেসব রিকশার ব্যাটারিগুলো জব্দ করে থানায় নেওয়া শুরু করে। পরবর্তীতে সেসব অটোর ব্যাটারিগুলো পুলিশ আলাদাভাবে পাঁচ হাজার টাকা দরে বিক্রি করছে বলে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বহিষ্কৃত আরেক যুবলীগ নেতা এই অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্য নিজ দখলে নিতে এলাকায় সুকৌশলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শত শত ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকিয়ে রাখেন। পরে বিক্ষুব্ধ রিকশা চালকরা ৩ নস্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস পর্যন্ত ভাঙচুর চালান। জানা গেছে, গোটা মিরপুর থেকে প্রতি মাসে অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্য বাবদ হাতিয়ে নেওয়া হয় অন্তত ৭ কোটি টাকা। এর ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই দলীয় কোন্দলের সৃষ্টি হয়। শাহআলী, মিরপুর মডেল, দারুস সালাম, রূপনগর, পল্লবী, কাফরুল, ভাষানটেক থানা এলাকায় অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রীতিমতো অস্ত্রের মহড়াও চলে। ইদানীং কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও মিরপুরের ৯টি রুটে চলাচলকারী ইজিবাইক থেকে প্রতি মাসে ১২ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পল্লবী থানার সাব ইন্সপেক্টর সজীব খান চাঁদাবাজ কিশোর গ্যাংয়ের সর্দার সুজনকে গ্রেফতার করায় এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
নিষিদ্ধ তবু তৈরি হচ্ছে হরদম : সরকার ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিকশা-ভ্যানের যন্ত্রাংশ আমদানি, প্রস্তুত ও কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলেও প্রতিদিনই রাজধানীতে প্রস্তুত হচ্ছে শতাধিক ইজিবাইক ও অটোরিকশা। ছড়িয়ে পড়ছে তা রাজধানীসহ দেশের আনাচে-কানাচে। কমলাপুর স্টেডিয়াম মার্কেটের ইজিবাইক প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক ব্যবসায়ী সামসুদ্দিন আহমেদ ছোটন জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞার আগেই ৫/৬ লাখ ইজিবাইক আমদানি করা হয়েছিল। এগুলোর বডি ফিট করে বিক্রির মাধ্যমে কোনো রকমে পুঁজিটা তুলে নিতে হচ্ছে। এখন নতুনভাবে কোনো ইজিবাইক আমদানি করা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন সামসুদ্দিন আহমেদ। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সারা দেশে ইজিবাইক-অটোরিকশা চলছে দেদার। অনুমোদন না দেওয়ায় সরকার এ খাত থেকে কোনো রাজস্ব না পেলেও স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র ও একশ্রেণির অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা গাড়িগুলো চলাচলের মৌখিক অনুমতি দিয়ে আদায় করে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। অন্যদিকে বিআরটিএর রুট পারমিটের বদলে স্থানীয় থানা পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগ হাতিয়ে নিচ্ছে মাসোহারা। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর ব্যস্ততম কোনো রাস্তায় ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত অটো চালানোর সুযোগ নেই। বরং প্রতি মাসেই এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।