মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ই-কমার্স প্রতারণার প্রতিকার নেই ভোক্তা অধিকারেও

মানিক মুনতাসির

করোনাভাইরাস মহামারীতে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বহু মানুষই কেনাকাটা করতেন অনলাইন প্ল্যাটফরম ই-কমার্সে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ই-কমার্স জমজমাট রূপ নেয়। এরই মধ্যে নানা রকমের অস্বাভাবিক অফার দিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তৃত করে অনেক কোম্পানি। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে হরহামেশা প্রতারণার শিকার হন সাধারণ ভোক্তারা। অবশ্য অতি লোভের ফলেও কেউ কেউ সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর ঢিলেঢালা কার্যক্রমের কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ই-কর্মাস কোম্পানিগুলো। প্রতারিত গ্রাহকরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করেও আশানুরূপ প্রতিকার পাচ্ছেন না। এমনকি অনলাইনে অভিযোগ দায়েরের মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও মামলার শুনানি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় না। প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারীর কারণে সরকারি সব সংস্থার মতোই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কাজে নেমে আসে স্থবিরতা। যদিও বেসরকারি খাতের সব এবং সরকারি খাতের অনেক সংস্থাই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে অনলাইনের মাধ্যমে। অনেক ই-কমার্স কোম্পানি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয় প্রতারণার জাল বিছিয়ে।

কেস স্টাডি- : গত ১৪ মে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে একটি অভিযোগ দায়ের করেন একজন বেসরকারি চাকরিজীবী, যার ট্র্যাকিং নম্বর : ২০০০০৮০৫৪। তিনি অভিযোগটি মূলত প্রথম দায়ের করেন ২০ এপ্রিল। প্রায় এক মাসে কোনো আপডেট না পেয়ে পরে তিনি ১৪ মে আপিল করেন। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, ২০ এপ্রিল অভিযোগ দায়ের করার পর এখনো এর শুনানিই অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ এই ট্র্যাকিং নম্বর লিখে ভোক্তা অধিকারের ওয়েবসাইটে সার্চ করলে স্ট্যাটাসে দেখাচ্ছে আপিলকৃত এবং শুনানির সম্ভাব্য তারিখ দেখাচ্ছে ১৪ জুলাই ২০২১। ওই অভিযোগনামায় বলা হয়- ‘৮ এপ্রিল আমি অনলাইন শপ দারাজে দুই জোড়া জুতা অর্ডার করেছিলাম, যার এক জোড়া ১৮ এপ্রিল ডেলিভারি দেওয়া হয়। আমি সাইজ চেয়েছিলাম ৪১। আমাকে দেওয়া হয়েছে ৪০। আর এর যে কোয়ালিটি, তাতে এক দিনও পায়ে দেওয়া যাবে না। ডান পায়েরটা তো পেস্টিংই খোলা। অর্থাৎ ছেঁড়া জুতা ডেলিভারি দেয় দারাজ। কালার এবং ডিজাইনও মেলেনি। ডেলিভারি দেওয়া জুতা ছিল খুবই নিম্নমানের। অথচ অর্ডার দেওয়ার সময় যে ছবি দেখানো হয় সেটার মান, রং, সেলাই ছিল বেশ উন্নত মানের।’ ছেঁড়া জুতা হাতে পেয়ে দারাজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেন ওই ক্রেতা। এ সময় তিনি দারাজের কাস্টমার কেয়ার অফিসার ফারহান কোরাইশি, পিআরও তিশা এবং চিফ মার্কেটিং অফিসার আবরার হাসনাইনের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করেন। এতে কোনো সমাধান না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করেন। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো প্রতিকার পাননি ওই ভোক্তা।

এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বলেন, ‘গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করাই আমাদের প্রধান কাজ। কোনো বিক্রেতা বা কোনো কোম্পানির কাছ থেকে কেউ প্রতারিত হলে আমাদের কাছেই আসেন। আমরা এই সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়েই কাজ করি। তবে করোনা মহামারীর কারণে সম্প্রতি কার্যক্রমে কিছুটা ছেদ পড়েছে।’ এ ছাড়া সংস্থাটির প্রয়োজনীয় লোকবলেরও অভাব রয়েছে বলে জানান তিনি।

কেস স্টাডি- : ব্যাংকার নাজমুল ইসলাম। ছয় মাসের বেশি সময় আগে ইভ্যালিতে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার দেন। টাকাও পরিশোধ করেন নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু মোটরসাইকেল ডেলিভারি দেয়নি ইভ্যালি। ডেলিভারির নির্দিষ্ট সময়ের পর আরও এক মাস পেরিয়ে গেলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ দায়ের করেন নামজুল। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান পাননি। এখন অবশ্য প্রতারণার অভিযোগে নিজেরাই ফেঁসে গেছেন ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডি।

এ রকম শত শত প্রতারণার ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। ই-কমার্সে বিভিন্ন রকম ফোলানো-ফাঁপানো অফার দেখিয়ে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার নেই কোথাও।

অথচ ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১ বা ই-কমার্স নীতিমালা (সংশোধিত), ২০২১-এর ৩.২.৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘যে সকল পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো মান নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সনদ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে পণ্যের বিবরণে মান নিয়ন্ত্রণ সনদের উল্লেখ থাকতে হবে।’ অর্থাৎ পণ্যের গুণগত মান নির্ণয়ের জন্য বিএসটিআই বা তদ্রƒপ কোনো সংস্থার সনদ থাকতে হবে। গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় বা পণ্যের মান ঠিক নেই এমন কোনো পণ্য গ্রাহককে দেওয়া যাবে না। কিন্তু দেশে বিদ্যমান ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগই কোনো ধরনের জবাবদিহির আওতায় নেই। আবার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মনিটরিং ব্যবস্থাও খুবই ঢিলেঢালা। এ খাতে যে যার মতো করে ব্যবসার নামে প্রতারণা করে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ই-কমার্স খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশে জমজমাট রূপ নিয়েছিল। কিন্তু এ খাতে সরকারের কোনো মনিটরিং না থাকায় যে যার মতো ব্যবসার নামে প্রতারণা করে এসেছে। একেকটি কোম্পানি গড়ে ওঠার শুরুতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে এসব কোম্পানিতে মানুষ একদিকে বিনিয়োগ করেছে, অন্যদিকে কোম্পানিগুলোও তাদের প্রতারণার জাল বিস্তৃত করেছে। আর শেষে এসে যখন ধরা হয়, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সাধারণ ভোক্তাদের। এতে সরকারেরই দায় সবচেয়ে বেশি বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর