ঘরে ঘরে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে যাওয়ায় দ্রুত বিকশিত হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং খাত। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। তবে ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের বড় একটি অংশ থেকে যাচ্ছে বিদেশেই। লেনদেন সংকটে অনেকে উপার্জিত ডলার বিদেশেই অন্যের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বিনিময়ে দেশে ওই ব্যক্তির প্রতিনিধির কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছেন টাকা। কেউ আবার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে না পেরে বিদেশি ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কিনে খরচ করছেন। উপার্জনের বড় একটি অংশ ব্যয় হচ্ছে বিদেশ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় টুলস কিনতে। বিদেশে অর্থ পাচারে ফ্রিল্যান্সারদের ডলার কিনে নিচ্ছেন অনেকে।
ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশ প্রযুক্তি খাতে অনেক এগোলেও এখনো ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রয়োজনীয় টুলসের জন্য বিদেশের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এসব টুলসের অধিকাংশের দাম ৪০০ ডলার থেকে শুরু। ফলে এ খাতেই উপার্জনের বড় একটি অংশ চলে যায়। দ্বিতীয় সমস্যা হলো দেশে ডিজিটাল লেনদেন প্ল্যাটফরম ‘পেপাল’ চালু না হওয়া। ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ ক্লায়েন্ট পেপালে বেশি আস্থা রাখে। কারণ, ফ্রিল্যান্সারের কাজে সন্তুষ্ট না হলে তারা ডিসপুট দিতে পারে। তখন তাদের পরিশোধিত অর্থের একটি অংশ ফেরত দেয় পেপাল। এ কারণে বাংলাদেশের অনেক ফ্রিল্যান্সার বিদেশে অবস্থানরত পরিচিত কারও পেপাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অথবা কৌশলে ফেক পেপাল অ্যাকাউন্ট তৈরি করে। তবে ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রান্সফার করে ডলার দেশে আনতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকে। তখন ডলারসহ অ্যাকাউন্টটি বাতিল হয়ে যায়। এ জন্য এসব অ্যাকাউন্টে জমা ডলার বিদেশেই কারও কাছে বিক্রি করে দেয় ফ্রিল্যান্সাররা। বিনিময়ে দেশে তার স্বজন থেকে টাকা নিয়ে নেয়। আবার অনেকেই বিদেশে অর্থ পাঠাতে ফ্রিল্যান্সারদের ওসব অ্যাকাউন্ট থেকে কম দামে ডলার কিনে নেয়। অনেকে অবৈধ উপার্জন বিদেশে পাঠাতে ফ্রিল্যান্সারদের থেকে ডলার কিনে নেয়। এতে একদিকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে, অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের প্রকৃত অঙ্কটাও থেকে যাচ্ছে অজ্ঞাত। বাংলাদেশ আইটি প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইটিপিএ) সহসভাপতি ও অ্যারিকো আইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পলাশ প্রসেনজিৎ মালাকার বলেন, টাকা আনার জন্য স্ক্রিল, পেওনিয়ারসহ নানা গেটওয়ে আছে। তবে কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে পেপালে ক্লায়েন্ট নিরাপদ বোধ করে। এ জন্য আমরা পেওনিয়ার, স্ক্রিল বা অন্য কোনো মাধ্যমে পেমেন্ট নিতে চাইলে ইউরোপ-আমেরিকার ৩০-৪০ ভাগ ক্লায়েন্ট রাজি হয় না। বাংলাদেশের ব্যাংকিং কাঠামোর সঙ্গে পেপালের ম্যাচ করে না। তাই ২০১৭ সালে ব্যাংকিং স্ট্রাকচার বদলের কথা বলে পেপাল তাদের সিস্টার কনসার্ন জুম চালু করে দিয়ে যায়। কিন্তু জুমের মাধ্যমে ক্লায়েন্টরা সবসময় পেমেন্ট করতে চায় না। কারণ এই গেটওয়েতে টাকা রিফান্ডের ব্যবস্থা নেই। তাই ফ্রিল্যান্সাররা ফেইক পেপাল অ্যাকাউন্ট করে। দেশের কিছু ব্যবসায়ী ওসব অ্যাকাউন্টের ডলার কিনে নেয়। আবার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিস দিতেও অনেকে এটা কিনে নেয়। তিনি বলেন, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় পেপাল আছে, অথচ ফ্রিল্যান্সিংয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ হলেও বাংলাদেশে নেই। এটা থাকলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয় অনেক বেড়ে যেত। বড় ফ্রিল্যান্সাররা অনেক বড় অ্যামাউন্টের ডলার বিদেশেই বিক্রি করে দেয়। পেপাল বৈধ হলে কেউ বিদেশে ডলার পাঠিয়ে দিলে সরকার ট্রেস করতে পারত। এখন কোনো হিসাবই থাকছে না। এদিকে অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী- বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিশ্বে দ্বিতীয়। ভারতের পরেই অবস্থান। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) মতে, ফ্রিল্যান্সিং থেকে প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বাংলাদেশে ঢুকছে। মার্কেট প্লেসে সরাসরি বিড করা ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখের ওপরে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছে আরও অনেক কর্মী। পেপালও ব্যবহার হচ্ছে, তবে অবৈধভাবে। এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরাও চাই পেপাল আসুক। তবে তারা যদি বলে, তাদের কোনো নিয়মে বাঁধা যাবে না, সেটা তো সম্ভব নয়। যে দেশে যে আইন, সেটা মেনেই তাদের ব্যবসা করতে হবে। তাদের জন্য পুরো ব্যাংকিং পদ্ধতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়। দেশ থেকে ইচ্ছামতো ডলার নিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমাদের মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে হয়। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) চেয়ারম্যান ডা. তানজিবা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে টাকা আনার অনেক উপায় থাকলেও বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট পেপালে ভরসা করে। তবে কেউ দেশের পাশাপাশি আমেরিকায় কোম্পানি খুলে বৈধভাবে পেপাল অ্যাকাউন্ট পেতে পারেন। আমিও সেভাবে পেপাল অ্যাকাউন্ট করেছি। তার মতে, পেপাল নয়, দেশের অনেক দক্ষ ফ্রিল্যান্সারের কাজ না পাওয়ার পেছনে দায়ী যোগাযোগ অদক্ষতা। তারা ক্লায়েন্টকে বুঝিয়ে কাজ বুঝে আনতে পারছে না।.