সোমবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

অবরুদ্ধ উপাচার্য, বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ

শাবিপ্রবি নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছেন নতুন অনেকেই

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও শাবি প্রতিনিধি

অবরুদ্ধ উপাচার্য, বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্যালাইন ও অক্সিজেন দেওয়া হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সময় যত গড়াচ্ছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) চলমান সংকট ততই যেন ঘনীভূত হচ্ছে। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় ভার্চুয়ালি বৈঠকের পরও নিজেদের এক দফা দাবি থেকে সরে আসছেন না আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। উপাচার্যের পদত্যাগের ইস্যু ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা আর আলোচনায় আগ্রহী নন বলেও জানিয়েছেন। আন্দোলনের ১১তম দিনে আমরণ অনশনে যোগ দিয়েছেন নতুন আরও কয়েক শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনের ফটকে অবস্থান নিয়ে কাউকে ভিতরে যেতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। যে কোনো সময় গ্যাস ও পানির সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। সংকট নিরসনে গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি ভবনে যান। ভবনের ১২৯ নম্বর রুমে আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। দুই ঘণ্টার বৈঠকে মনে হয়েছিল হয়তো অবশেষে আন্দোলনে বরফ গলবে। কিন্তু বৈঠক থেকে কোনো সমাধান আসেনি। গত শনিবার রাতে বৈঠক শেষে শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনশনকারী ২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৭ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এভাবে অনশন চললে অন্যরাও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর কথা হয়েছে। রবিবার (গতকাল) শিক্ষার্থীদের লিখিতভাবে তাদের দাবি-দাওয়া দেওয়ার কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। আইনগত ও একাডেমিক সমস্যা যাতে না হয় সেজন্য তিনি সব বিষয় দেখবেন বলেও আশ্বস্ত করেছেন।’ কিন্তু গতকাল আর বৈঠক হয়নি।

পদত্যাগ ইস্যু ছাড়া আলোচনা নয় : আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গতকাল জানিয়েছেন, তারা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় রাজি। তবে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ ইস্যু ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তারা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী নন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে নাফিসা আনজুম ও মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, ‘ভার্চুয়াল বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেননি। উনি অন্য সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছেন। এ মুহূর্তে আমাদের এক দফা দাবি  উপাচার্যের পদত্যাগ। এই ইস্যু ছাড়া আর কোনো বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করতে আগ্রহী নই। যদি উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনা করতে শিক্ষামন্ত্রী আগ্রহী হন তাহলে আমরা আলোচনায় আবারও বসতে রাজি আছি।’

উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মানবপ্রাচীর : গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মানবপ্রাচীর তৈরি করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া উপাচার্যের বাসভবনের ভিতরে আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। প্রেস ব্রিফিং করে আন্দোলনকারী নাফিসা আনজুম ও মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন, ‘পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে আরও কঠোর কর্মসূচির দিকে যেতে। তারা বলেন, ভিসির বাসভবনে কেবল পুলিশ ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না। ভবিষ্যতে তারা উপাচার্যের বাসভবনের জরুরি পরিষেবা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন বলেও জানান।’ প্রেস ব্রিফিংয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেব। আমরা অবরুদ্ধ করছি বিষয়টি ঠিক এভাবে না, আমরা ভিসির বাসভবনের ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেব না। আমরা ওখানে বসে অনশন করছি, আর সবাই গিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করবেন- সেটা হয় না। এ কারণে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।’

আমরণ অনশনের ১০০ ঘণ্টা, যোগ দিলেন আরও পাঁচ শিক্ষার্থী : গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় আমরণ অনশনের ১০০ ঘণ্টা পূর্ণ  হয়েছে। নতুন করে আরও পাঁচ শিক্ষার্থী অনশনে বসেছেন। এদের মধ্যে দুজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে। অনশনের ১০০ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ায় শাবি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী মশাল মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা।

ক্যাম্পাসের বাইরের সহিংসতার দায় নেবে না আন্দোলনকারীরা : চলমান আন্দোলনকে কেউ যদি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে চায় এবং সহিংসতায় জড়ায়, তবে এর দায়ভার কোনোভাবেই আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা নেবেন না। গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যারা একাত্মতা পোষণ করেছেন তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন শিক্ষার্থীরা। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৪ জানুয়ারি থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেন, যা এখনো চলমান। দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আমাদের এই যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। সে জন্য তাদের আমরা অনেক ধন্যবাদ জানাই।

শাবিতে এসে ঢাবির দুই শিক্ষার্থীর সংহতি : উপাচার্যে পদত্যাগ দাবিতে চলমান আন্দোলনে ক্যাম্পাসে এসে সংহতি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুই শিক্ষার্থী। গতকাল দুপুরে এসে তারা এই সংহতি জানান। ঢাবির এ দুই শিক্ষার্থী হলেন- ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। সংহতি প্রকাশের সময় নাঈম হাসান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর ক্যাম্পাসের ভিতরে পুলিশ দিয়ে যে হামলা চালানো হয়েছে তা খুবই জঘন্য। এর পর থেকেই শাবির শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে পূর্ণ সহমত।’

শাবি ছাত্রলীগের সাবেক ১০৫ নেতার বিবৃতি : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে শনিবার শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের এক জরুরি ভার্চুয়াল সভা হয়। এতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রআন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতারা। ভার্চুয়াল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি মো. ফরিদ আলম। সভাটি পরিচালনা করেন চতুর্থ ব্যাচের ছাত্র ও শাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন আহমেদ।

অনশন ভাঙাতে যা যা করা দরকার করতে হবে- শাবি শিক্ষক সমিতি : অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর জন্য যা যা করা দরকার তা অনতিবিলম্বে করতে হবে। এ ব্যাপারে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

গত রাতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস এবং মহিবুল আলম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর বর্বরোচিত পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ীদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত। এ ক্ষেত্রে অতিদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনো রকম সহিংসতায় সম্পৃক্ত না হওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বানও জানান তারা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল ছাত্র জোট। গতকাল বেলা ২টায় বিশ্ববিদ্যালয় ডায়ানা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে এসে মিলিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন সংসদের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক পিয়াসের নেতৃত্বে উপস্থিত ছিলেন দফতর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, কোষাধ্যক্ষ ওবাইদুর রহমান আনাস, দেলোয়ার, সুমন এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা শাহরিয়ার আমিনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

সর্বশেষ খবর