রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র উন্নয়নে অঙ্গীকার চায় যুক্তরাষ্ট্র

আগামী ডেমোক্র্যাসি সামিটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে দিয়েছে শর্ত । তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার, বিরোধী দলের নেতা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সুশীলসমাজের বিপর্যয়ে উদ্বেগ

জুলকার নাইন

বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাসি সামিটের আগামী বছরের আয়োজনে আমন্ত্রণ চেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ মার্কিন আন্ডার-সেক্রেটারির ঢাকা সফরে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারি সংলাপ’-এ বিষয়টি আলোচনায় তুলেছিলেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য নেওয়া ‘দৃশ্যমান উদ্যোগ’ এবং কিছু ‘অঙ্গীকার’ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অষ্টম অংশীদারি সংলাপের সভার কার্যবিবরণীতে এ তথ্য উঠে এসেছে। কার্যবিবরণীতে বলা হয়- সংলাপে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বলেন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আগামী ডেমোক্র্যাসি সামিটে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পাবে। সেই সঙ্গে প্রথম ডেমোক্র্যাসি সামিটে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত না করাকে বিস্ময়কর হিসেবে অভিহিত করেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আয়োজনে আগামী ডেমোক্র্যাসি সম্মেলন সরকারপ্রধানদের সরাসরি অংশগ্রহণে হবে। এতে আমন্ত্রণ পেতে হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির আরও উন্নয়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রদর্শন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু অঙ্গীকার করতে বলা হয়। প্রথম ডেমোক্র্যাসি সম্মেলনে অংশ নেওয়া কিছু দেশ এ ধরনের অঙ্গীকার করেছে বলেও উল্লেখ করেন মার্কিন প্রতিনিধিরা। সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়- ‘এ ধরনের অঙ্গীকার আগামী ডেমোক্র্যাসি সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাতে হোয়াইট হাউসকে অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা’। সংলাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের জানান, যথাসময়ে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন-২০২২ সফলভাবে পাস করা হয়েছে।

কার্যবিবরণী অনুসারে সংলাপের আটটি এজেন্ডার মধ্যে একটি ছিল ‘গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম ও র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা’ প্রসঙ্গ। এর মধ্যে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ ইস্যুর আলোচনার শুরুতে মানব পাচার রোধে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উদ্যোগ ও টিআইপি রিপোর্টে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার এবং বিরোধী দলের নেতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সুশীলসমাজের বিপর্যয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। র‌্যাবের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ সরকারের অস্বস্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবগত বলে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ থাকার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টিকে জটিল ইস্যু উল্লেখ করে এর সমাধানে সময় প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতা দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। প্রথমত, বিচারবহির্ভূত হত্যায় অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কীভাবে তদন্ত করেছে বা করছে। দ্বিতীয়ত, র‌্যাবকে কী পদ্ধতিতে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হয়। বলা হয়- বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি র‌্যাব ও এর বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়- একতরফা এ সিদ্ধান্তে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ, মাদক ও মানব পাচারের মতো অপরাধ দমনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করবে। কার্যবিবরণী হিসেবে র‌্যাব ও এর কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞার জবাবে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরা হয় সংলাপে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সংলাপের কার্যবিবরণীর শেষাংশে মূল্যায়ন অংশে বলা হয়- মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ অষ্টম অংশীদারি সংলাপ হলো। আগামী দু-তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সিরিজ বৈঠকের প্রথম বৈঠক ছিল এ সংলাপ। বিশেষত ডিসেম্বরে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক রাজনৈতিক সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়। তবে এ অংশীদারি সংলাপ এ উদ্বেগ দূর করবে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকতে চায় তা উপলব্ধি করাবে। নিষেধাজ্ঞা উত্তোলনের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোরালো, নিয়মিত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। এ সম্পর্ক শুধু নিষেধাজ্ঞা উত্তোলনে পরোক্ষ সহযোগিতাই করবে না বরং এতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি করবে। ২০ মার্চ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত অংশীদারি সংলাপে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন ১২টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রাজনৈতিক বিষয়ে আন্ডার-সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুলান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড ল্যু, স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইকোনমিক ব্যুরোর ডিরেক্টর, ইন্দো প্যাসিফিক সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের প্রিন্সিপাল ডেপুটি সেক্রেটারি, মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সেলর এবং পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক ইউনিটের চিফসহ যুক্তরাষ্ট্রের আরও ছয় প্রতিনিধি।

সর্বশেষ খবর