রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

পরিকল্পনাহীন প্রশাসনে সমন্বয়হীনতা

উবায়দুল্লাহ বাদল

পরিকল্পনাহীন প্রশাসনে সমন্বয়হীনতা

অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, বন্যা, পাহাড়ধসসহ দেশের যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবার আগে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা। তাঁদের উদ্ধারকারী যন্ত্রপাতিও কেনার বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। কারণ এ-জাতীয় দুর্যোগে সার্বিক তদারকি করে সরকারের এ মন্ত্রণালয়টি।

ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ৯০ ভাগ কাজই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত। অথচ এ অধিদফতরটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন। একইভাবে দেশের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিসংক্রান্ত সেবা দেয় সাবরেজিস্ট্রার অফিস। জমিজমা নিবন্ধন, নামজারি সংক্রান্ত জটিল সমস্যার সমাধান মেলে এ অফিসে। অথচ ভূমিসংক্রান্ত এ অফিসটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। এটি আইন ও বিচার বিভাগের নিবন্ধন পরিদফতরের অধীন। মুসলিম বিধানমতে বিয়ে বা নিকাহ পড়ানো ও নিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন কাজি। দেশের এ কাজি অফিসগুলো থাকার কথা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু এটিও আইন ও বিচার বিভাগের নিবন্ধন পরিদফতরের অধীনে। এ ছাড়া দেশের মেডিকেল কলেজগুলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অধীনে থাকলেও এর প্রধান স্টেকহোল্ডার চিকিৎসকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ। কিন্তু কেউ কারও কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীন প্রশাসনে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের পরিকল্পনাহীন প্রশাসনে সমন্বয়হীনতা থাকলেও গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে সাবরেজিস্ট্রার অফিসের কর্তৃত্ব দাবি করেছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। একই দিন তা নাকচ করে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ডিসি সম্মেলনের শেষ দিনে (২০ জানুয়ারি) ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কর্ম অধিবেশন শেষে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সাবরেজিস্ট্রাররা ভূমির কাজ করেন, অথচ তাঁরা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন। ভূমি ব্যবস্থাপনার কাজে সমন্বয় করাটা জটিল হয়। এটি আমার একটি কষ্টের জায়গা। কী কারণে কেন এটা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন দেওয়া হলো আমার বোধগম্য নয়। সাবরেজিস্ট্রাররা আশা করি ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় চলে আসবেন।’

ওই দিনই সন্ধ্যায় ডিসি সম্মেলনের আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কর্ম অধিবেশন শেষে ভূমিমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। ভূমিমন্ত্রীর দাবি নাকচ করে দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অনুশাসন দিয়েছেন। এটা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন থাকবে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে অনুশাসন দিয়েছেন সেখানে এ বিষয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।’

এর আগে ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাবরেজিস্ট্রার অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন আনার সুপারিশ করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বৈঠকে বলা হয়- জমির মালিকানা পরিবর্তনের দলিল করার ক্ষেত্রে সহকারী কমিশনার ভূমি, সেটেলমেন্ট অফিস ও সাবরেজিস্ট্রার অফিস যুক্ত। এর মধ্যে সাবরেজিস্ট্রার অফিস আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ তিনটি কার্যালয়কে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন আনার কথা বিভিন্ন সময় বলা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ। ওই চিঠিতে বলা হয়- একসময় আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয় একত্রে ছিল। পরে পৃথক হওয়ার সময় ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকে যায়। ভূমি ব্যবস্থাপনা কাজে গতি আনতে এ তিনটি শাখাকে একই মন্ত্রণালয়ের অধীন আনা প্রয়োজন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ওই দিনই সংসদ সচিবালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- বৈঠকে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সাবরেজিস্ট্রার অফিসকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল আইন সচিব ও ধর্ম সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কাজী হাবিবুল আউয়াল যখন আইন সচিব ছিলেন তখন কাজি অফিসগুলো ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন দেওয়ার একটি প্রস্তাব তৈরি করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি স্টেকহোল্ডার হিসেবে কাজিদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতি’র সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এটি করা হলে দেশের কাজিরা আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংগঠনটির সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা ড. মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা তৎকালীন আইন সচিব হাবিবুল আউয়াল স্যারকে বলি আমরা যেহেতু নিবন্ধনের কাজ করি সেহেতু আমাদের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন থাকাই যুক্তিযুক্ত। এ বিষয়ে তৎকালীন মন্ত্রীর সহায়তা চাইলে বিষয়টি আর এগোয়নি।’

২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন করার সময় তৎকালীন খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীন আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতার কারণে সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। এখনো বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে ফায়ার সার্ভিসকে নির্দেশনা দিতে হয় সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাধ্যমে।

২০১৭ সালে প্রশাসনিকভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ভাগ হয়ে ‘স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ’ এবং ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ’ নামে দুটি বিভাগ করা হয়। এতে মেডিকেল কলেজ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অধীন রাখা হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করার অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়- ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভাগের সময় প্রধানমন্ত্রী যে অনুশাসন দিয়েছিলেন তা ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় মানা হয়নি। এ কারণে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের কার্যক্রম সম্পাদনে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।

সব সরকারি মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, ডেন্টাল কলেজ, ম্যাটস ও আইইএইচটিগুলোর বিভিন্ন পদে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরতদের বদলি, পদোন্নতি ও পদায়ন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে করায় মেডিকেল কলেজগুলোর প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা ও জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের স্থাপনাগুলোর নির্মাণ ও মেরামতের কাজ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু আজ অবধি এ সমস্যার সমাধান হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

সর্বশেষ খবর