দিনাজপুরের বিরামপুরের ষাটোর্ধ্ব মিজানুর রহমান গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ জ্ঞান হারান। দ্রুত দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান স্বজনরা। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসকরা জানান মিজানুর রহমান স্ট্রোক করেছেন, অবস্থা সংকটাপন্ন। উন্নত চিকিৎসার জন্য স্বজনরা রাতেই দিনাজপুর থেকে রওনা হয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাকে।
মিজানুর রহমানের মেয়ে আফিফা রহমান বলেন, বাবাকে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আনতে চলে যায় ১১ ঘণ্টা। এখানে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা বলেন, চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ সময়টা রাস্তায় নষ্ট হয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে রোগীর পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়েছে। দ্রুত হাসপাতালের স্ট্রোক ইউনিটে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে এ চিত্র প্রতিদিনের। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে অসংখ্য রোগী আসে এ হাসপাতালে। করোনা সংক্রমণ কমে আসায় হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে নিউরো সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর চাপ। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে স্ট্রোক এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া রোগীর সংখ্যা। বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ে নিউরো রোগীদের চিকিৎসা অপ্রতুল। এসব হাসপাতাল থেকে রেফার্ড করে রোগী পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিউরো মেডিসিন এবং নিউরো সার্জারিতে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাড়ছে রোগীর চাপ। স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়া রোগী বেশি। প্রতি পাঁচ মিনিটে আসে একজন স্ট্রোকের রোগী। এসব রোগী সামাল দিতে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্ট্রোকের রোগীদের দ্রুত উন্নত সেবা দিতে হাসপাতালের ১০ তলায় আমরা স্ট্রোক ইউনিট করেছি। এখানে শুধু রোগী পৌঁছে দেন স্বজনরা, বাকি সব সেবা হাসপাতাল নিশ্চিত করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অত্যাধুনিক নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসাসেবার প্রতিষ্ঠান হলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল। রোগীরা উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। প্রতিদিন প্রচুর রোগী আসছে এই হাসপাতালে। তাই আগামী বছর হাসপাতালের সম্প্রসারিত ভবনে আরও ৫০০ শয্যা চালু হবে। সেখানে আলাদা ট্রমা ইউনিট থাকবে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে থেকে এখানে আসে। স্ট্রোকের রোগী এত দূর থেকে আসায় চিকিৎসার গোল্ডেন আওয়ার নষ্ট হয়। এ জন্য বহুদিন থেকে ঢাকার বাইরে নিউরো চিকিৎসার সুবিধা বাড়াতে আমরা জোর দিচ্ছি। ঢাকার বাইরে আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ শয্যার নিউরোসায়েন্স ইউনিট করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখন এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৩ লাখ ২৪ হাজার ৩৪৮ জন, জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৫০ হাজার ৯০৪ জন। গুরুতর সার্জারি হয়েছে ২ হাজার ৫৮৮টি, কম গুরুতর সার্জারি হয়েছে ৫১৩টি। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বহির্বিভাগে রোগী কিছুটা কম ছিল। এ বছর হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৮৩ জন, জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬২ হাজার ১৬০ জন। গুরুতর সার্জারি হয়েছে ২ হাজার ৬০৭টি, কম গুরুতর সার্জারি হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৪টি। ২০২১ সালে হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯১ জন, জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬৬ হাজার ১৭৫ জন। গুরুতর সার্জারি হয়েছে ৩ হাজার ৫৮টি, কম গুরুতর সার্জারি হয়েছে ১ হাজার ৭৮২টি। ৪৫০ শয্যার এই হাসপাতালে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র চিকিৎসকরা। স্ট্রোকের রোগীদের সেবা দিতে হাসপাতালে ১০০ শয্যার স্ট্রোক ইউনিট রয়েছে। হাসপাতালে ২০০ জন চিকিৎসক, ৪০০ নার্স রয়েছেন রোগীদের চিকিৎসায়। এর মধ্যে ১০০ জন নার্স আইসিইউ, এইচডিইউতে দায়িত্ব পালন করেন। এই ইনস্টিটিউটে স্ট্রোক, মৃগীরোগী, জিবিএস, স্মৃতিভ্রম, ব্রেনের রক্তনালিতে ইনফেকশন, ব্রেন টিউমার, ব্রেন স্টেইন, মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার ট্রিটমেন্ট, শিশুদের জন্মগত ত্রুটি, মাথা বড় হওয়াসহ নানা ধরনের নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল শীর্ষ স্পেশালাইজড পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতাল ক্যাটাগরিতে একাধিকবার স্বাস্থ্যসেবায় সেরার পুরস্কার পেয়েছে। রোগীর তুলনায় হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা সীমিত হওয়ায় অনেক সময় রোগী ভর্তি নিতে পারে না এই হাসপাতাল। উপায়ন্তর না পেয়ে তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী রেফার্ড করেন চিকিৎসকরা। এই হাসপাতালগুলোতেও নিউরো সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর ভীষণ চাপ থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৪০-৫০ জন রোগী আসে। প্রতিদিন ভর্তি হয় ৪৫-৫০ জন। প্রতিদিন ৫-৭ জন স্ট্রোকের রোগী ভর্তি হয়। প্রতিদিন সার্জারি হয় ১০-১২টি। এর মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি হওয়া দুর্ঘটনার রোগী থাকে। তিনি আরও বলেন, নিউরো সমস্যা নিয়ে রোগী ভর্তি বেড়েছে। ঢাকা মেডিকেলে রোগী ফিরিয়ে দেওয়ার নজির নেই। অন্য হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা না থাকায় ফিরিয়ে দেওয়া রোগীও আমরা ভর্তি করে নিই।