প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কভিড-১৯ মহামারির কারণে খাদ্য, বিদ্যুৎ ও আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সু-সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে চারটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, যার জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধ এমন এক সময় এসেছে যখন বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারি থেকে উদ্ধার পেতে লড়াই করে চলেছে। এ যুদ্ধ ইতোমধ্যে নাজুক বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর চাপ যুক্ত করেছে। গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে যুক্ত হয়ে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ (জিসিআরজি) এর প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন। শেখ হাসিনা কার্যকরভাবে সংকট মোকাবিলায় উন্নত অর্থনীতি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবে বলেন, প্রথমত, আমাদের বৈশ্বিক সংহতি জোরদার এবং সু-সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জি-৭, জি-২০, ওইসিডি এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, আমি দেখে খুশি হয়েছি যে, এ গ্রুপের স্টিয়ারিং কমিটিতে প্রধান সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো তৈরির জন্য আমরা তাদের পূর্ণ সমর্থন দেব। দ্বিতীয় প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হলো বৈশ্বিক লজিস্টিক এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাঘাত মোকাবিলা করা। এটা পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং রপ্তানি আয় পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থনও থাকতে হবে, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলোর জন্য। এ ছাড়া উন্নত অর্থনীতি ও বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, শুল্কমুক্ত- কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার এবং আরও সহজলভ্য আর্থিক ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে জানান তিনি। তৃতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা জানান, কার্যকর খাদ্য সঞ্চয় ও বিতরণ ব্যবস্থার জন্য কৃষি খাতে প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে, বিশেষ করে এলডিসিগুলোতে (স্বল্পোন্নত দেশ) ব্যবসার ক্ষেত্রে আনকোরা অনেক সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে বিদ্যমান উত্তর-দক্ষিণ, দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে জানিয়ে এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সব শেষে ৪৮ সদস্যের ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসেবে উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র (এসআইডি) এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলোর জন্য কাজের সুযোগ পাওয়ার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সেসব দেশে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে, যোগ করেন তিনি।
এ সময় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের উদ্যোগ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের জাতীয় উন্নয়ন যাত্রায় উদ্ভাবনী অনেক জলবায়ু কার্যক্রম রয়েছে। আমরা অন্যদের সুবিধার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের জ্ঞান, বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা তাদের জানাতে চাই। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী। আমরা সব সময় বৈশ্বিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। সেই প্রত্যয় থেকেই এ গ্রুপকে আমাদের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতির উৎসারিত হয়। শেখ হাসিনা বলেন, জাতি হিসেবে ভয়ংকর সব চ্যালেঞ্জের মুখেও আমাদের সহনশীলতার পরিচিতি রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারি তার সর্বশেষ উদাহরণ। মহামারি থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের মহামারি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা জীবন এবং জীবিকা রক্ষার মধ্যে একটি সতর্ক ভারসাম্য দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমরা আমাদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের সামনে রেখেছি। যারা সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে তাদের সহায়তা দিতে আমরা সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে বিস্তৃত করেছি। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন কেনার জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় বড় একটি স্বাস্থ্য সংকট এড়িয়ে যাওয়া গেছে এবং তাতে জীবন রক্ষা পেয়েছে।রপ্তানি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) সহায়তা দিতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ চালুর কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। এসব পদক্ষেপের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরবরাহের স্বল্পতা এবং খাদ্য, জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে।
এ বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানোয় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে ধন্যবাদ জানিয়ে মর্যাদাপূর্ণ এ চ্যাম্পিয়ন্স গ্রুপের অংশ হতে পেরে সম্মানিত বোধ করছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এমন একটা সময়ে এসেছে যখন পুরো বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে নাজুক হয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এটা গুরুতর চাপ হয়ে উঠছে। বিশ্বজুড়ে আর্থিক এ সংকট মোকাবিলায় নিজেকে গ্লোবাল সাউথের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি এ সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের কণ্ঠস্বরকে এই টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছি।
তিনি জানান, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে (এসআইডি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বইতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাদের জন্য সহায়তার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বিনিময় : ব্রাজিল-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারো শুভেচ্ছাপত্র বিনিময় করেছেন। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশকে ব্রাজিলের স্বীকৃতির কথা স্মরণ করে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ব্রাজিলের সরকার এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বলসোনারো তার শুভেচ্ছাবার্তায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের সূচনালগ্নে ব্রাজিলের সেই স্বীকৃতি দুই দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের পথ সুগম করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁর অপরিসীম অবদানের কথা স্মরণ করেন।
শেখ হাসিনা ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং রাষ্ট্রপতি বলসোনারো সাদরে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।