মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার মাঠ

দুই দশকে নেই ৪৮ মাঠ, হাই কোর্র্ট নির্দেশ দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি

হাসান ইমন

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার মাঠ

রাজধানীর পল্লবীর অগ্রদূত মাঠ। এটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের হলেও প্রভাবশালী চক্র দখলে নিতে বুলডোজার দিয়ে শহীদ মিনার ও পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর মিরপুর এলাকার পল্লবী থানাধীন অগ্রদূত মাঠ। এটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাঠ। এই মাঠটিতে ৩০ কাঠা জমি থাকলেও বর্তমানে ১০ কাঠা রয়েছে। বাকি ২০ কাঠার মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পানির পাম্প ও পানির ট্যাংক স্থাপন করেছিল সরকার। বর্তমানে ১০ কাঠা খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও সেটি দখলে নিতে মরিয়া স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র। চক্রটি মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে এক পাশে থাকা শহীদ মিনার ও পাঠাগার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গোলারটেক মাঠ। এ মাঠটির এক অংশে মিরপুর দারুস সালাম থানার জব্দকৃত বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাসের দখলে। আরেক অংশে জিবিএইচবি ক্লাব আর সূচনা সমবায় সমিতির অফিস। আবার কিছু অংশ ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য নেট দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছেন প্রভাবশালীরা। আর ছোট একটি অংশে খেলছে শিশুরা।

মালিবাগ চৌধুরীপাড়া সবুজ সংঘের মাঠ। এটি গণপূর্ত অধিদফতরের দুই বিঘা জমির মাঠ। বর্তমানে এটিতে আনসার-ভিডিপি গ্যারেজ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট মাঠটি দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। একই সঙ্গে এক বছরের মধ্যে আধুনিক শিশুপার্ক হিসেবে গড়ে তুলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে (ডিএনসিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আনসার-ভিডিপির আবেদনের কারণে সেই রায় আপিল বিভাগে আটকে আছে। ফলে আজও সেই মাঠ দখলমুক্ত হয়নি।

শুধু অগ্রদূত, গোলারটেক ও মালিবাগ চৌধুরীপাড়া সবুজ সংঘের মাঠ নয়, এমনিভাবে গত দুই দশকে রাজধানী থেকে হারিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক মাঠ। ঢাকার অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি শতকের শুরুতেও নগর কর্তৃপক্ষের অধীনে মাঠ ছিল ৬৮টি। অন্যদিকে রাজধানীতে বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঠ আছে ২০টি। সে হিসাবে দুই দশকে রাজধানীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে অন্তত ৪৮টি মাঠ। এর মধ্যে কোনো কোনোটিকে এখন পার্কে রূপ দেওয়া হয়েছে। চলতি শতকের শুরুতেই রাজধানীর খেলার মাঠগুলো বেদখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালে রাজধানীর খেলার মাঠ ও পার্ক বেদখলের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে একটি রিট করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পক্ষ থেকে ২০০৪ সালে একই বিষয়ে আরেকটি রিট হয়। এ দুই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর ৬৮টি খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য সংরক্ষিত জায়গা ১৫ দিনের মধ্যে দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। এ আদেশ যথাযথভাবে পালনে গত দুই দশকে কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। বরং দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। একের পর এক মাঠ বেদখল হয়ে নির্মাণ হচ্ছে বাজার, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়সহ নানা ধরনের স্থাপনা। কোনো কোনো মাঠে উন্মুক্ত জায়গা থাকলেও খেলার পরিবেশ নেই। এসব জায়গায় মাদক ব্যবসাসহ আরও নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমেরও অভিযোগ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তখন আমরা শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত মাঠগুলো নিয়ে রিট করেছিলাম। আদালত মাঠ ও পার্ক দখলমুক্ত করতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এর বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘মাঠগুলোর অবস্থা দেখতে আমরা সরেজমিনে ঘুরছি। এগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন পাঠাব। প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো পদক্ষেপ না নেন তাহলে আমরা আবার কোর্টে যাব।’ তবে ঢাকার সব মাঠই সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে নেই। দুই সিটির অধীন মাঠ ছাড়াও ঢাকায় আরও অন্তত ২০০ খোলা জায়গার তথ্য পাওয়া যায়, যেগুলোকে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) জরিপে উঠে আসে, কয়েক বছর আগেও ঢাকায় মাঠের সংখ্যা ছিল ২৩৫। এর মধ্যে ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ, যেগুলো ওই প্রতিষ্ঠানের কম্পাউন্ডের ভিতরে অবস্থিত। অর্ধশতাধিক জায়গা ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। এসব খোলা জায়গা শিশুরা মাঠ হিসেবে ব্যবহার করত। পরে সেসব জায়গায় অট্টালিকা গড়ে ওঠে। ৪২টির মতো মাঠ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে আবার ১৬টি বেদখল হয়ে পড়েছে। ফলে এখন রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ও আওতাবহির্ভূত উন্মুক্ত মাঠ আছে মাত্র ২৪টি। এর মধ্যে কিছু খেলার মাঠ সংস্কার করায় সেগুলোর সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ-পার্ক প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে বিগত দুই বছরে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে লক্ষ্মীবাজার খেলার মাঠ, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে টিকাটুলি খেলার মাঠ, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে আলমগঞ্জ খেলার মাঠের উন্নয়নের পর সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বকশীবাজার খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘৭০ নম্বর ওয়ার্ডে মেন্দীপুর খেলার মাঠ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাসাবো বালুর মাঠ এবং ২ নম্বর ওয়ার্ডে ভূঁইয়ার মাঠের উন্নয়নে আমাদের কর্মযজ্ঞ চলমান রয়েছে।’ সিটি করপোরেশনের খেলার মাঠগুলোর মধ্যে ১২টি ঢাকা দক্ষিণ সিটির অধীনে। ঢাকা উত্তরের অধীনে রয়েছে আটটি। ঢাকা দক্ষিণের ১২টি মাঠ হলো বাংলাদেশ মাঠ, গোলাপবাগ মাঠ, মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা মাঠ, লালবাগ শ্মশানঘাট খেলার মাঠ, খিলগাঁও খেলার মাঠ, ধানমন্ডি খেলার মাঠ, কলাবাগান খেলার মাঠ, মরহুম হাজি আলী ঈদগাহ মাঠ, বালুর মাঠ, ঈদগাহ মাঠ, আরমানিটোলা খেলার মাঠ, ধূপখোলা মাঠ ও জোড়াপুকুর খেলার মাঠ। ঢাকা উত্তর সিটির আটটি খেলার মাঠ হলো- বনানী মাঠ, বনানী খেলার মাঠ, বড় মগবাজার খেলার মাঠ, গোলার টেক মাঠ, তাজমহল রোড মাঠ, জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠ, সলিমুল্লাহ রোড খেলার মাঠ ও বৈশাখী খেলার মাঠ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর