রাজধানীর হাই কোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বরসহ আশপাশের এলাকায় সংঘটিত রণক্ষেত্রে অংশ নেওয়া হেলমেট পরিহিত ও অস্ত্র হাতে ওরা কারা? দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রবেশ করা হামলাকারীদের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় নানা মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা। কয়েকদিন ধরে বিশেষ করে গত বৃহস্পতিবারের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হচ্ছে। পুলিশ বলছে, হেলমেট পরে সহিংসতায় অংশ নেওয়া অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের খোঁজা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ৩১টি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে তাদের নাম পরিচয় শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ছাত্রদল-ছাত্রলীগের মধ্যে আবারও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ঢুকে অপরাধ সংঘটিত করে কেউ পার পেয়ে গেলে আর কিছু তো বাকি থাকে না। তবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহ্্দীন মালিকের কাছে। হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, প্রথম কথা হলো বিশ্বের গণতন্ত্র যত সংকুচিত হয়, সেই সব দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং রাজনীতির নামে সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এটাই আমাদের হচ্ছে। এগুলো ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ছে। এর প্রতিফলনই আমরা আদালত প্রাঙ্গণে দেখলাম। এর আশু প্রতিকারের সত্যিকার কোনো উপায় এখন আর নেই। এসব মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। জানা গেছে, ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ৩৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন। তিনটি মামলার মধ্যে ঢাবি ক্যাম্পাসের মঙ্গলবারের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনকে আসামি করে বুধবার শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে বৃহস্পতিবার ঢাবি ক্যাম্পাস সংলগ্ন হাই কোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বরসহ আশপাশের এলাকায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ক্যাম্পাসে বছরের পর বছর ধরে সহাবস্থান চলছে। ক্যাম্পাসে কী এমন হয়েছে, জঙ্গি মনোভাব নিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য লাঠিসোঁটা হাতে ঢুকতে হবে? আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলা হয়েছে, কার কী রাজনৈতিক পরিচয়, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে ভোরবেলা যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কী ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছেও প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে?
ফের সংঘর্ষের আশঙ্কা : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। তাদের মিছিল-মিটিংয়ের সময় অনেক বহিরাগতও অংশ নিচ্ছে। তাদের কারও কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানান অস্ত্র, লাঠি-সোঁটাও দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ফের সংঘর্ষ ঘটলে অনেক হতাহত হতে পারে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘর্ষের সময় উভয় পক্ষের নেতা-কর্মীদের হাতে লাঠি-সোঁটা, হকিস্টিক ও রড দেখা যায়। তাদের হাতে ইটের টুকরাও দেখা যায়। এ ছাড়া সেখানে অবস্থানকারী অনেক নেতা-কর্মীর মাথায় হেলমেট দেখা যায়। এ সময় দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। একপর্যায়ে গুলির শব্দ শোনা যায়। সেখানে অবস্থানকারী একজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তার নাম পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি জানিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ওই ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের আহত এক কর্মীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার নাম শাহাবুদ্দিন শিহাব। তিনি নিজেকে ঢাকা মহানগর (উত্তর) ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, আমরা হতবাক দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অভ্যন্তরে ঢুকে ছাত্রলীগ আমাদের ছেলেদের ওপর নারকীয় হামলা করেছে। তবুও তাদের বিরুদ্ধে আদালত থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও চোখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন এবং গুলি নিক্ষেপের ঘটনা ঘটার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ কেবল নিরীহ দুজন ছাত্রকে আসামি করে মামলা করেছে। আমরা এখন আমাদের গুরুতর আহত নেতা-কর্মীদের নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছি। কেন্দ্রীয় সংসদের দুই শীর্ষ নেতা সুস্থ হয়ে আসার পরই আমরা আইনি সিদ্ধান্তে যাব। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ হামলা করেনি বরং দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে ছাত্রদল।
মামলার বিষয়ে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, শুধু ছাত্রদল নয়, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে যে কেউ চাইলে থানায় মামলা করতে পারেন। এতে তারা কোনো বাধা দেন না।
হেলমেট ও অস্ত্রধারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ আদালতের অভ্যন্তরের ঘটনাটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। এ জন্য বিভিন্ন পয়েন্টের সিসিটিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন ছবি-ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। পরবর্তীতে আমাদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের এক বক্তব্যের পর গত রবিবার সন্ধ্যায় টিএসসি এলাকায় ছাত্রদলের কয়েক কর্মীর ওপর ছাত্রলীগ প্রথম হামলা করে। ওই ঘটনার প্রতিবাদ ও বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন ডাকে।