শনিবার, ৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কদর বাড়ছে ছোট দলের

জোট ও ভোটের রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম রনি ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

ক্ষমতার রাজনীতিতে এতদিন গুরুত্বহীন থাকলেও এখন কদর বাড়ছে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের। ভোট ও জোটের রাজনীতিতেই এ কদর। বড় দলের নেতারা ছুটে যাচ্ছেন ছোট দলের নেতাদের অফিসে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে নামসর্বস্ব দলগুলোকে ভিড়ানোর জন্য। আবার ভোটের আগে ‘টোপ’ দিচ্ছেন জোটেও। বরাত খুলে গেলে এই ছোট দলগুলোও হবে ক্ষমতার ভাগীদার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত ছোট ছোট দলগুলোর দরজায় কড়া না নাড়লেও বিএনপির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশি ভালো যাচ্ছে না। গত ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ১৪ দলের শরিকরা। সেখানে পাওয়া না পাওয়ার কথাগুলো তুলে ধরেন তারা। জোটকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে বলা হয়। এখন শরিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ঐক্য সংহত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জোট গঠন রাজনীতিতে নতুন কিছু না। বিএনপি চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যর্থ হবে। আমরা ১৪ দল আছি, থাকব। ১৪ দলীয় জোটের ঐক্য আরও অটুট হবে। আগামীতে কোনো নতুন দলকে নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময় এলে দেখা যাবে। আপাতত এমন কোনো পরিকল্পনা নেই।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাসসহ সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে গোটা দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। যারা গণতন্ত্র চায়, দেশ সঠিকভাবে চলুক চায়- তারা একটা প্ল্যাটফরম খুঁজছিলেন। আর বিএনপি তাদের সবাইকে এক ছাতার নিচে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। বৈঠক নিয়ে ছোট দলগুলোও বেশ ফুরফুরে মেজাজে। নির্বাচনের আগে বড় দলগুলোর দৌড়ঝাঁপ দেখে নিজেদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে তারা। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব এসব দল এখন নিজেদের দামি ভাবতে শুরু করেছে।

এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক  বলেন, গণআন্দোলন ও গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই সরকারকে যদি পদত্যাগে বাধ্য করা না যায় তাহলে মানুষের ভোটের অধিকার বলি, গণতান্ত্রিক অধিকার বলি অথবা একটা তদারকির সরকার, অবাধ গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অথবা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কোনোটাই বাংলাদেশে নিশ্চিত করা যাবে না। সেজন্য আমরা আন্দোলনে একমত হয়েছি।

আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক, রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এসব দলকে বড় দুই দল জোটে টানছে।

জানা গেছে, বিএনপি ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করায় টনক নড়ে আওয়ামী লীগের। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ অন্যরা ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। ১৪ দলের ঐক্য বাড়াতেই বেশি ব্যস্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করবে। এ মুহূর্তে মহাজোট সম্প্রসারণের দলীয় চিন্তা না থাকলেও অনেকটা কৌশল থেকেই ছোট দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন তারা। আওয়ামী লীগের নেতারা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তারা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের ভাবনায় সিপিবি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে। 

জানা গেছে, বড় দলের টানাটানিতে ছোট দলগুলো হিসাব-নিকাশ কষছে। কার সঙ্গে গেলে কতটুকু রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা হবে, তা নিয়ে ব্যস্ত তারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক ধারা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা না থাকায় দলগুলো মহাজোট অথবা চারদলীয় জোটেই যেতে চায়। তা ছাড়া দলগুলোর নেতাদের বড় দুই দলের বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে অনেকে মনে করেন। পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, বড় দলের ছোট নেতা হওয়ার চেয়ে ছোট দলের বড় নেতা হওয়ার সুবিধা বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেভাবে ছোট দলগুলোর অফিসে ছুটে চলেছেন, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিলও একইভাবে ছোটাছুটি করেন। এতে ইতিবাচক ফল পেয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলেই ২০০৪ সালে ১৪ দলীয় জোট। এরপর এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এখন টার্গেট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিত করা। এ জন্য জোটসহ জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে চলেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কখনো গুলশানে বিএনপির কার্যালয়ে আবার কখনো দলগুলোর কার্যালয়ে বৈঠকে বসছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, ২৫ মে ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে। ২৭ মে ২০-দলীয় জোট শরিক দল মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির সঙ্গে। ১ জুন ৭-দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ শরিক দল গণসংহতি আন্দোলন জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে। ১ জুন ৭-দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের নেতৃত্বে। আর পঞ্চম সংলাপ ২ জুন ২০-দলীয় জোট বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীকের (শরিক দল) সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির সংলাপ। এরপর কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ হবে এখনো আনুষ্ঠানিক তারিখ জানানো হয়নি বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, সব দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে যেসব প্রস্তাব আসবে, সেগুলোর সমন্বয়ে তৈরি করা হবে আন্দোলনের রূপরেখা। সংলাপ শেষে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছালে, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হবে। সেখানে সব দলের একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। সমন্বয়ক হবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরুর আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে কয়েক দফায় আলোচনা হয়েছে। সেখানে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিএনপির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মিল থাকায় এখন আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শুরু করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর