আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে সরকারকে প্রধানত পাঁচটি শর্ত মানতে হবে। অবশ্য সরকার বলছে, শর্তগুলো জানতে পারলে এবং আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এলে তাদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অর্থ বিভাগ বলছে, প্রাথমিক আলোচনা অনুযায়ী ক) বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ সার্বিক বাজেট ভর্তুকি কমিয়ে আনা, ভর্তুকির তথ্য আইএমএফকে প্রদান করতে হবে। খ) খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, ব্যাংকসহ সমগ্র আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। কার্যকর থাকা ব্যাংকের সুদের ৬, ৯ হার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। গ) কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। ঘ) প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অতিমূল্যায়ন বন্ধ করতে হবে। মেগা প্রকল্পসহ সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ঙ) বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে না। বিশেষ করে ডলারের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ না করে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। তবে এগুলো চূড়ান্ত নয়। শর্ত আরও বাড়তে পারে। কেননা আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দলকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সে দলের সঙ্গে শর্ত ও ঋণের বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, আইএমএফের যে কোনো ঋণ পেতে কোনো না কোনো শর্ত মানতে হয়। এটা অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশকেই কিছু না কিছু শর্ত মানতে হয়। গত মাসে প্রাথমিকভাবে ১২ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে। সে সময় দলটির সঙ্গে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এর পরই বাংলাদেশ ঋণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে। আইএমএফ অবশ্য গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে আশা করা হচ্ছে খুব শিগগিরই আইএমএফের আরেকটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসবে ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য।
গত মাসে ঢাকা সফরের সময় আইএমএফ প্রতিনিধি দল ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাবের ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। সেখানে কিছু শর্ত নিয়েও প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ। আইএমএফের ঋণ পেতে হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। এ ছাড়া অন্তত ১০ বছর ধরে এসব এ খাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।
ক্ষয়িষ্ণু ব্যাংক খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষায় সরকার কভিডকালীন অচলাবস্থায় ব্যাংক সুদ ৬ ও ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে যা এখনো চলমান। এর বাইরে শিল্প, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে কয়েকটি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়। সে অর্থ কারা পেয়েছে, কী কাজে লেগেছে? এতে কভিড পরিস্থিতির জন্য কতটা সহায়ক ছিল সেসব তথ্যও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এ জন্য ব্যাংকসহ সমগ্র আর্থিক খাতের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার শর্তারোপ করা হতে পারে এই ঋণের বিপরীতে।
করোনা মহামারির প্রভাবে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ছন্দপতন ঘটেছে। যার ফলে সরকারের তহবিলে টান পড়েছে। আবার বৈশ্বিক সংকটের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমদানি-রপ্তানি খাতসহ সামগ্রিক আর্থিক খাত নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। এমতাবস্থায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলায় বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করার ব্যাপারেও সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ আইএমএফের ঋণ পেতে হলে সরকারকে এ শর্তও মানতে হবে।
বর্তমানে ডলারের বাজারে চরম এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১২ টাকায় উঠেছে। এমনকি ব্যাংক খাতেও ডলারের দাম ১০৫ টাকায় উঠেছে। তবুও এলসি খুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বিরাজ করছে ভারসাম্যহীনতা। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়াও সরকারের নানা রকম হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে মনে করে আইএমএফ। এ জন্য বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও ভারসাম্য রক্ষায় এ বাজারে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। বিশেষ করে ডলারের সীমা, দাম নির্ধারণ, ডলার ধরে রাখা ইত্যাদিতে কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণারোপ করা যাবে না।
সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোর কেনাকাটায় বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। এতে অনেক প্রকল্পই অতিমূল্যায়িত হয়েছে, হচ্ছে। এসব নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। আইএমএফের ঋণ পেতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি, অতিমূল্যায়ন রোধ করতে হবে। মেগা প্রকল্পসমূহে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক আলোচনায় এসব বিষয় নিয়েই কথা হয়েছে দুই পক্ষের বলে জানা গেছে।
এদিকে বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সুশাসনের অভাবে দেশের আর্থিক খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশই অবশ্য একই অবস্থায় রয়েছে। ফলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এই দুর্বলতার সুযোগটা যেন কোনো দেশ বা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা নিতে না পারে। তাই যে কোনো বিদেশি ঋণ নিতে হলে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ।
বৈশি^ক মহামারি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। সংকটে পড়া বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির উন্নতি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ চাঙা করা এবং মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা আনতে আইএমএফের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা প্রত্যাশা করছে সরকার। আগামী তিন বছরে বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সুদমুক্ত সুবিধায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। যা দেশের ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে সহায়তা দেবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ এবং ‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট’ ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও গত আট বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা পরিস্থিতি নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, এতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আরও কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।