শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
উত্তরায় বিআরটির গার্ডার পড়ে হতাহত

সক্ষমতা ফিটনেস কোনোটাই ছিল না ক্রেনের, চালিয়েছিল হেলপার

নিজস্ব প্রতিবেদক

সক্ষমতা ফিটনেস কোনোটাই ছিল না ক্রেনের, চালিয়েছিল হেলপার

উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর উত্তরায় বিআরটির নির্মাণাধীন প্রকল্পে গার্ডার দুর্ঘটনায় ক্রেনের সক্ষমতার চেয়ে গার্ডারের ওজন ছিল ২০ টন বেশি। ফলে অতিরিক্ত ভারে ক্রেনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। ক্রেনের ধারণক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ ৫০ টন। কিন্তু গার্ডারের ওজন ছিল ৭০ টন। এ ছাড়া ক্রেনের ফিটনেস ছিল না। এ ধরনের হেভি ওয়েটের (অতিরিক্ত ভার) গার্ডার শিফট করার ক্ষেত্রে কাউন্টার লোড ব্যবহার করা উচিত ছিল। পাশাপাশি আরেকটি ক্রেন স্ট্যান্ডবাই রাখা উচিত ছিল। যার কিছুই সেদিন দেখা যায়নি। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান  বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকারের দায়িত্ব ছিল আজমপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিরাপত্তা দেখভাল করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার এসএসসি পাস। গার্ডার স্থানান্তরের সময় কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, ছিল না নিরাপত্তাব্যবস্থা। লোকবল কম ছিল। যারা দায়িত্বে ছিলেন তারাও ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। দুর্ঘটনার দিন বেলা ২টার দিকে গার্ডার স্থানান্তর শুরু হয়। ক্রেন অপারেটর আল আমিন একটি গার্ডার স্থানান্তর করে নিচে নেমে যান। পরে বিকাল ৪টার দিকে আরেকটি গার্ডার স্থানান্তরের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন হেলপার রাকিব। অপারেটর আল আমিনের হেভি যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। বিআরটি প্রকল্পের থার্ডপার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। ক্রেনটি আনুমানিক ১৯৯৬-৯৭ সালে আনা হয়েছিল। প্রথমে ক্রেনটির সক্ষমতা ছিল ৮০ টন। পরে আস্তে আস্তে এর সক্ষমতা কমে যায়। সব শেষ ক্রেনটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। এ ছাড়া ২০২১ সালে শেষবারের মতো ফিটনেস যাচাই করা হয়। এরপর ক্রেনটির আর ফিটনেস যাচাই করা হয়নি। এর আগে বুধবার রাতে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাটে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১, ৩, ৪, ৬ ও ১২ যৌথ অভিযান চালিয়ে নয়জনকে গ্রেফতার করে। এরা হলেন- ক্রেনচালক মো. আল আমিন হোসেন হৃদয়, রাকিব হোসেন, দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিকম্যান রুবেল, আফরোজ মিয়া, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ, হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার হোসেন, হেড অব অপারেশন আজহারুল ইসলাম মিঠু, ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন তুষার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা ও মঞ্জুরুল ইসলাম। র‌্যাবের মুখপাত্র মঈন বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন আজহারুল ইসলাম মিঠু। ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ডপার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিকম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের, হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন-চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর দু-তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। গ্রেফতার রাকিব তিন মাস আগে এ প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার ক্রেন-চালনা করার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিন আল আমিন ও রাকিব বেলা ২টায় ক্রেন-চালনা শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় গার্ডারটি ছিল ক্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের। এটি উত্তোলনের সময় ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে গার্ডারটি প্রাইভেট কারের ওপর ছিটকে পড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন এ প্রতিষ্ঠানের কাছে ছিল না। তাই বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর, হেলপারসহ এ ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয় তারা। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন মিঠু ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করে, দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই না করে অপারেটরদের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োগ করেছিলেন। এ ছাড়া গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। থার্ডপার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেন সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার তুষার ক্রেনের ভাড়া প্রদান, চুক্তি, চালক নিয়োগ, ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। রুহুল আমিন ২০১০ সালে ও তুষার ২০১৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছাড়া অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল ২০২১ সালে। রুবেল তিন মাস আগে ও আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিসে ট্রাফিকম্যান হিসেবে যোগ দেন। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা দুর্ঘটনাস্থলে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এদিকে গার্ডার দুর্ঘটনায় যাত্রী হতাহতের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি পুনর্গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতারকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের ওই কমিটিতে সদস্য রয়েছেন- ডিএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মুহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ, এডিসি ট্রাফিক উত্তর বদরুল হাসান, বিআরটির প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খান, ঢাকা ফেরি সার্কেলের সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী ও বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আসিফ রায়হান। কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন ঢাকা জোনের সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অন্য এক আদেশে বিআরটি প্রকল্পের নিরাপত্তার বিষয় যথাযথভাবে নিশ্চিত করে প্রকল্পের কাজ সম্পাদনের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর