রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

হাই কোর্টে মামলা চার বছর

আরাফাত মুন্না

২১ আগস্ট ২০০৪। ১৮ বছর আগে এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চালানো হয়েছিল ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। ২৪ জন নিহত ও ৫ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় বিচারিক আদালতে রায় হয়েছে চার বছর আগে। দুই বছরেরও বেশি সময় আগে হাই কোর্টে শুনানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি-সংবলিত বই) প্রস্তুত হয়েছে। তবে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির উদ্যোগ দেখা যায়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, বহুল আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছেন তিনি। ফলে শিগগিরই শুনানি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে শিগগিরই শুনানি শুরুর কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রীও। তিনি বলেন, এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দেওয়া বিচারিক আদালতের রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। একই অপরাধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। আরও ১১ আসামিকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। রায়ে আদালত বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদে চালানো হামলার উদ্দেশ্য। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন জানায়, এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দুই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি গ্রহণে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু পেপারবুক ছাপা শেষ হয়ে গত বছরই সুপ্রিম কোর্টে এসে পৌঁছেছে। হত্যা মামলায় ১৩ ভলিউমে মোট ৫৮৫টি এবং বিস্ফোরক মামলার জন্য ১১ ভলিউমে মোট ৪৯৫টি পেপারবুক প্রস্তুত রয়েছে। হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্সের পাশাপাশি ২২টি আপিল ও ১২টি জেল আপিল দায়ের হয়েছে। অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলায় ১৭টি আপিল দায়েরের পাশাপাশি ১২টি জেল আপিল দাখিল করেছেন আসামিরা। এখন শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই মামলা দুটি শুনানির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানিতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু পেপারবুক ছাপা হয়ে সুপ্রিম কোর্টে এসেছে বছর দুই আগে। বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ ধারা অনুযায়ী, নিম্ন আদালত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে তা কার্যকরের জন্য হাই কোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর মামলার সব নথি হাই কোর্টে পাঠানো হয়, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে হাই কোর্টে এন্ট্রি হয়। একই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দণ্ডিতরা আপিল ও জেল আপিল দায়ের করেন। ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিল একসঙ্গে শুনানি হয়। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও বিচারিক আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার অনেক বিলম্বে শুরু হয়েছে। আবার বিচার করতে গিয়ে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানো হয়েছে। সে কারণে অধস্তন আদালতে বিচার শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটি এখন উচ্চ আদালতে আছে। শিগগিরই এ মামলার আপিল শুনানি শুরু করা হবে। তিনি বলেন, এ মামলার ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত তৎপর। এ মামলার সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামিদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চেষ্টা করছে সরকার। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ হামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তাই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার দুটি মামলা বিচারিক আদালতের রায়ের পর এখন হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। সে কারণে বেঞ্চ নির্ধারণে আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছি।’ সামনে সুপ্রিম কোর্টের যে অবকাশকালীন ছুটি রয়েছে (১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর), এর পরই প্রধান বিচারপতি গুরুত্বপূর্ণ এ মামলা শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা।

ফিরে দেখা : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং নেতা-কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ ৫ শতাধিক লোক আহত হন। অল্পের জন্য বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণেন্দ্রিয় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। হামলার দিন রাতেই এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করেন। পরদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি। মামলা ভিন্ন খাতে নিতে বিএনপির নীতিনির্ধারক অনেকে সে সময় একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করেন। তারা জজ মিয়া নাটক মঞ্চায়নের সব আয়োজন সম্পন্ন করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের দিকে সন্দেহের আঙুল তুলে বিএনপি দিতে থাকে নানা বক্তৃতা-বিবৃতি।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পুনঃ তদন্ত শুরু হয়। তখন বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবীর। এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দীন, হুজিবি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরই মামলা দুটি দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ নিয়ে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২ জন।

অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষের (রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ) যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন (বর্তমানে হাই কোর্টের বিচারপতি) রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন। ১০ অক্টোবর রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে চাঞ্চল্যকর এ মামলা দুটির রায় ঘোষণা করেন বিচারক। এরপর ২৭ নভেম্বর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ও যাবতীয় নথিপত্র ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে পাঠানো হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম (কারাগারে মৃত্যু), সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ (পলাতক), মাওলানা মো. তাজউদ্দীন (পলাতক), মাওলানা শেখ আবদুস সালাম (কারাগারে মৃত্যু), মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ, রফিকুল ইসলাম ও উজ্জ্বল ওরফে রতন।

যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি : তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব (কারাগারে মৃত্যু), মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবুবকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) ও রাতুল আহম্মেদ বাবু (পলাতক)।

তিন আইজিপিসহ ১১ জনের দুই তিন বছর সাজা : পুলিশের সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন, এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ ও এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক (কারাগারে), সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা (কারাগারে), সাবেক আইজিপি শহুদুল হক (কারাগারে), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন (পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (পলাতক), ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান (পলাতক) ও ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার খান সাঈদ হাসানকে (পলাতক) দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর