বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

চলছে না বিআরটিসি

হাসান ইমন

চলছে না বিআরটিসি

দেশে নামমাত্র পরিবহন সেবা দিচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। যেখানে বেসরকারি বাস দিন দিন রুটের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে সেখানে বিআরটিসি উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ। শুধু রাজধানীতে ৩৮৬টি রুট রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ৪৩টি রুটে ৫০০ বাস চলছে সরকারি এই সেবাদাতা সংস্থাটির। এ ছাড়া সংস্থাটির বহরে থাকা সচল বাস ১ হাজার ১৯৫টি, এর মধ্যে ৩২ শতাংশ বাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটিসির প্রতি সরকারকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। কারণ সারা দেশের বেসরকারি বাসের সংখ্যার তুলনায় ১ শতাংশ বাস নেই বিআরটিসির। একই সঙ্গে জনবল সংকট ও আধুনিক ওয়ার্কশপ না থাকায় ধুঁকছে সংস্থাটি। ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে সারা দেশে আরও বাস বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে।

বাসের সংখ্যা কমছে : প্রতি বছরই কমছে বিআরটিসি বাসের সংখ্যা। সরকারি এই সংস্থাটির আওতায় ২০০০ সালের পর সারা দেশে তাদের বহরে ২ হাজার ২০৪টি বাস যুক্ত ছিল। এরপর ২০১৯ সালে বাসের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২৪টিতে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাসের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৭৬২টিতে। বর্তমানে  বিআরটিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সংস্থাটির বহরে বাস আছে ১ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে সচল আছে ১ হাজার ১৯৫টি। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্রমেই বাসের সংখ্যা কমছে। তবে সচল বাসের পরিমাণ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। একই অবস্থা মহিলা বাসের। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন রুটে কর্মজীবীসহ অন্যান্য মহিলাদের বিভিন্ন গন্তব্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ৯টি রুটে ৯টি মহিলা বাস চলাচল করছে। অথচ ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ রুটে ২৩টি বাস চলাচল ছিল।

৩২ শতাংশ বাস ইজারায় : বিআরটিসির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকার ৪১টি রুটে চলাচলকারী ৫০০টির বেশি বাস চলাচল করছে। দৈনিক গড়ে রুটে বাস চলে ১২টি। এসব রুটের মধ্যে গুলিস্তান থেকে নরসিংদী, মেঘনা, গৌরীপুর; কুড়িল বিশ্বরোড থেকে ভুলতা, বিশনন্দী, ইটাখোলা; মতিঝিল থেকে গাজীপুর; গাবতলী থেকে গাজীপুর; চিটাগাং রোড থেকে সাভার এবং যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়ার মতো পথও রয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে এ সংস্থার ৩৮৩টি বাস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া; বাকি ৮৫২টি গণপরিবহন হিসেবে চলে। অন্যদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে চলাচলকারী বাসগুলোর ৩২ শতাংশ বাস ইজারায় চলে। যার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং শিক্ষার্থী পরিবহন করে থাকে।

চাহিদার তুলনায় সংখ্যা খুবই কম : এখনো যাত্রীদের পছন্দের তালিকায় এগিয়ে আছে বিআরটিসি। অথচ চাহিদার তুলনায় এর সংখ্যা খুবই কম। মতিঝিল থেকে উত্তরা ও মিরপুর রুটে চলাচলকারী বিআরটিসি বাসের যাত্রী বরাবরই বেশি। বিশেষ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বাস সেবা রাজধানীতে এখন পর্যন্ত বিআরটিসিই দিয়ে আসছে। তবে বিআরটিসি থেকে লিজ কিংবা ভাড়ায় নিয়ে চালানো বাসগুলোর ভাড়া আদায় নিয়ে আছে বড়সড় অভিযোগ। উত্তরা থেকে প্রতিদিন বাংলামোটরে এসে অফিস করেন রেজাউল হোসেন। বললেন, আগের তুলনায় এখন বিআরটিসি এসি বাসের ভাড়া বেড়েছে কিন্তু সেবার মান আরও কমেছে। বাস কমেছে। আগে সকাল ৮টার পর অহরহ বাস পাওয়া যেত। এখন ৮টার পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বাস পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এসি বাসগুলো যাত্রীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অথচ বাসের সংখ্যা কমেছে। বাস কম যাত্রী বেশি। অনেক ভিড় থাকে। তাই বাধ্য হয়ে বিআরটিসিতে চড়া বাদ দিয়েছি।

জরাজীর্ণ বাস : মতিঝিল থেকে মিরপুর, মিরপুর থেকে গুলশান-বাড্ডা, মতিঝিল থেকে উত্তরা ও বনানী এবং পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কে চলাচল করা এসি ও নন-এসি বিআরটিসি বাসের অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা বাধ্য হয়েই চড়ছেন বিআরটিসি বাসে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই বাহনে যাতায়াতে যাত্রীদের আগ্রহ থাকলেও বাসের দুর্দশায় সে আগ্রহে ভাটা পড়ছে যাত্রীদের। অন্যদিকে রাস্তায় নামা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও ওয়াইফাইসমৃদ্ধ ডিজিটাল বাস সার্ভিস চলছে ধুঁকে ধুঁকে। সড়কে জ্যামে আটকে থেকে যাত্রীরা যাতে ইন্টারনেট চালাতে পারেন, এমন ভাবনা থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিলে চালু হয়েছিল এ ব্যবস্থা। মতিঝিল থেকে উত্তরার পথে চলাচল বিআরটিসির এসি বাসে বসানো হয়েছিল রাউটার, ছিল বিনামূল্যে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সংযোগ। আর এ সুবিধায় যাত্রীরা যানজটে স্মার্টফোন-ট্যাব বা ল্যাপটপে ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারতেন। কিন্তু ইন্টারনেটের ধীরগতি থাকায় তা দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না বলে অভিযোগ এই বাসের যাত্রীদের। অনেক যাত্রী সরাসরি অভিযোগ করেন, ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা দেওয়ার কথা বলে বিআরটিসি আমাদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করছে। আর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব বাসেও কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। বিআরটিসি বাসের নিয়মিত যাত্রী চাকরিজীবী রাশেদুল আলম বলেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দীর্ঘ পথে বাসে ইন্টারনেট সুবিধা যাত্রীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল। শুরুর দিকে গতি ধীর হলেও বিরক্ত হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। এরপর এমন ধীর হলো যে ব্যবহারই করা যাচ্ছে না। ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বাস যাত্রী আমিনুল ইসলাম বলেন, বিআরটিসি বাসের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বডিতে জোড়াতালির কারণে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। বসার সিটের অবস্থাও খুব করুণ। অনেক বাসে ফোম ছাড়া চেয়ার স্থাপন করায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে শরীর ব্যথা করে। অন্য এক যাত্রী শিক্ষার্থী মামুন হোসেন বলেন, ধুঁকে ধুঁকে চলছে বিআরটিসি বাস। বাসগুলোর ভিতরের অবস্থা যেমন খারাপ, তেমনি বাইরের অবস্থাও। অনেক বাসের গ্লাস নেই, এতে বৃষ্টির পানিতে ভিজে যেতে হয়। আর হেলপারদের ব্যবহারও খুব খারাপ। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিআরটিসির মেনটেইন্যান্স, স্টোর, চালক কোনো খাতেই পর্যাপ্ত জনবল নেই। ওয়ার্কশপগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, পর্যাপ্ত স্পেয়ার পার্সও অনেক সময় থাকে না। ফলে নতুন গাড়িগুলো কয়েক বছর পরই নষ্ট হতে শুরু করে। নিজস্ব জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে গোটা বিআরটিসিকে নতুন করে ঢেলে না সাজালে এটা কখনই টেকসই সংস্থা হবে না। তিনি বলেন, বিআরটিসি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, দেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবহন সেবা দিয়ে যাবে। এ সংস্থাটিকে দেখে বেসরকারি পরিবহনগুলো যাতায়াত করবে। কিন্তু সংস্থাটি সে জায়গায় যেতে পারেনি। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান সংস্থাটিকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছেন। পরিবহন সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে বাসের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। আর রাজধানীতে এসি বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বিআরটিসি বাস চলাচলে কোনো রুট পারমিট লাগে না। আমরা চাইলে জনগণের স্বার্থে যে কোনো রুটে বাস চালু করতে পারি। বিভিন্ন সময় প্রাইভেট বাস মালিকরা রংপুর, নোয়াখালী, শরীয়তপুরসহ কয়েকটি স্থানে বাস বন্ধ করেছিল। এরই মধ্যে বন্ধ হওয়া এসব রুটের বাসগুলো আবার চালু হয়েছে। তিনি বলেন, সারা দেশে ২১৪টি রুটে দৈনিক ৭৫০টি বাস চলাচল করছে। তবে চাহিদার তুলনায় আমাদের বাসের সংখ্যা কম। নতুন ৩২০টি বাস আমাদের বহরে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এগুলো এলে কিছু অংশ বাস ঢাকা শহরে যুক্ত হবে, বাকিগুলো আন্তজেলায় যুক্ত করা হবে। আর আমরা চাইলেই গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে পারি না। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, জরাজীর্ণ বাসগুলো আমরা অপসারণ করছি। এগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই বাসগুলো টেন্ডার হয়ে গেলে রাস্তায় থাকা বাসগুলো ডিপোর ভিতরে নিয়ে আসা হবে। ডিপোতে জায়গা সংকটের কারণে বাসগুলো বাইরে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর