আজ ১০ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ জেলা শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ঢাকায় তখন চলছে কারফিউ আর ব্ল্যাক আউট। চূড়ান্তভাবে শত্রুকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে চারদিক থেকে এগিয়ে আসে যৌথবাহিনী। মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় রেডিও ঢাকা কেন্দ্রের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর অন্যতম বিমান ঘাঁটি ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর রকেট হামলায় বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়। একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহের দামাল ছেলেরা নিজ জেলাকে মুক্ত করেন। শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর, ভোলা, নড়াইল, নওগাঁর রানীনগর, সিলেটের বিশ্বনাথ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা। বগুড়ার সান্তাহার রেলস্টেশনে ভারতীয় বিমান বাহিনী বোমা হামলা চালালে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সান্তাহার রেলওয়ে জংশনের লোকোশেড ও মেশিনারিজ। সাভারের নয়ারহাটে রেডিও ট্রান্সমিশনের ওপর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় বেতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একটানা বিমান হামলায় অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর। কয়েকটা জাহাজে অন্য দেশের পতাকা উড়িয়ে পাকসেনারা সিঙ্গাপুরে পালানোর সময় বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এদিন মিত্র ও মুক্তবাহিনী দিনাজপুর, রংপুর এবং সৈয়দপুরে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সব রসদ বন্ধ করে দেয়। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। খুলনার বটিয়াঘাটায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালালে দুজন রাজাকার নিহত হয়। একজন আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এদিকে ৯ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী মাদারীপুর ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে যাবে খবর পেয়ে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ঘটকচর থেকে সমাদ্দার ব্রিজের পশ্চিমপাড় পর্যন্ত সড়কের ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ১০ ডিসেম্বর ঘটকচর ব্রিজ পার হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করে। প্রায় দেড় দিন যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২০ সৈন্য নিহত হয়।
এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘সব ধর্মের মানুষই সমানভাবে আমাদের ভাই। এই মহান আদর্শ রক্ষার জন্য আপনারা এবং আমরা সংগ্রাম করছি।’ রেডিও আকাশবাণীর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক বক্তব্যে সেদিন রাতে তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান ভারত প্রত্যাখ্যান করেনি আবার গ্রহণও করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। শত্রুরা এক ধর্মীয় যুদ্ধের মিথ্যা ও সর্বনাশা জিগির তুলেছে। বাংলাদেশের মানুষ বেশির ভাগই মুসলমান এবং তারা ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। সব ধর্মের মানুষ সমানভাবেই আমাদের ভাই আর তাই এই মহান আদর্শ রক্ষার জন্য আপনারা ও আমরা যুদ্ধ করছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্ভব হবে, যখন বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত ১ কোটি শরণার্থী নিজেদের ভিটায় ফিরে যেতে পারবে।’
পরাজয় আসন্ন জেনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সূচনা হয়। এদিন শান্তিনগরের চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।