রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপির ১০ দফা, এমপিদের পদত্যাগ

গোলাপবাগ মাঠেই হলো সমাবেশ, সংসদ বিলুপ্ত, নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির ১০ দফা, এমপিদের পদত্যাগ

রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে গতকাল সমাবেশ করে বিএনপি -জয়ীতা রায়

ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগ ও সংসদ বিলুপ্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ থেকে নিজেদের দলীয় সাতজন এমপির পদত্যাগ ঘোষণা করা হয়েছে। আজ তাঁরা সংসদ ভবনে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। সমাবেশে জাতীয় সংসদ থেকে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপিদেরও পদত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া গণসমাবেশে ঘোষণা করা হয়েছে সমমনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ‘গণমিছিল’ ও গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবিতে ‘বিক্ষোভ সমাবেশ’। গতকাল বিকালে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত এ বিশাল সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

লাখো মানুষের এ সমাবেশে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে, অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ভোট হতে হবে ব্যালটের মাধ্যমে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। তিনি বলেন, ‘আজকের সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। রাজধানীর খিলগাঁও, মতিঝিল, কমলাপুর, মুগদা, যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশের সর্বত্র লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। এ সরকার এখন জনতার ভয়ে ভীত। এজন্য আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। কিন্তু এতে শেষরক্ষা হবে না। মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে মহানগরী উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনু সমাবেশ পরিচালনা করেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বরকতউল্লা বুলু, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, যুগ্ম-মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দন খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম, গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, মোশাররফ হোসেন, জাহিদুর রহমান ও সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, সাবেক এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, তাবিথ আউয়াল, শরিফুল আলম, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, শেখ রবিউল আলম রবি, মঞ্জুর এলাহী, গোলাম কবির কামাল, আবু সালেহ চৌধুরী, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, শিরিন সুলতানা, যুবদলের মামুন হাসান, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল হাসান শ্রাবণসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শতাধিক নেতা বক্তব্য দেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জনগণ এ বিশাল সমাবেশ থেকে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। তারা এ সরকারকে সরে যেতে বলেছে। তারা আর আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশ্বাস করে না, ক্ষমতায় দেখতে চায় না। মানুষ এখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব চায়। তিনি বলেন, আজকে এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁকেসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে বুধবার গভীর রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুক্রবার বিকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হলেও তাঁদের দুজনকেই সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে বলে সমাবেশে অভিযোগ করা হয়। গতকাল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হলেও শুক্রবার বিকালে ডিএমপির অনুমতি পাওয়ার পর দুই ঘণ্টার মধ্যেই নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে ভরে যায় গোলাপবাগ মাঠ। সমাবেশস্থলসহ আশপাশ এলাকায় বিএনপির কয়েক লাখ নেতা-কর্মী অবস্থান নেন। শীত ও ঠান্ডা বাতাস উপেক্ষা করে কেউ মাঠে, কেউ রাস্তায় শুয়ে-বসে রাত কাটান। বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রঙের ব্যানার-ফেস্টুনসহ খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা সমাবেশস্থলে আসেন। এটি ঢাকা বিভাগের গণসমাবেশ হলেও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে উৎসাহী নেতা-কর্মীরা নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সমাবেশে এসে যোগ দেন। পুরান ঢাকার অপর্ণা রায় সেন, আদাবরের আবুল কালাম আজাদ ও মোহাম্মদপুরের হাজী মো. ইউসুফসহ অনেককে রাতের বেলায়ই রাজধানীর বিভিন্ন ইউনিট থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে দেখা যায়। সমাবেশে আসা নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখতে রাতভর মাইকে বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয় এবং পরিবেশন করা হয় দলীয় ও দেশাত্মবোধক গান। এর আগের নয়টি বিভাগীয় সমাবেশের মঞ্চে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য ছবিসংবলিত খালি চেয়ার রাখা হলেও ঢাকার সমাবেশ মঞ্চে সেটা দেখা যায়নি। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ করে ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘আপনারা প্রমাণ করেছেন নেতার জন্য নয়, আপনারা দেশের জন্য রাজনীতি করেন। এ সমাবেশ বানচাল করার জন্য প্রশাসন ত্রাস সৃষ্টি করেছে। মকবুল হোসেন নামে আমাদের একজন নেতা পুলিশের গুলিতে নিহত এবং আরও শত শত নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। আমাদের দলীয় কার্যালয়ের সব সম্পদ পুলিশ নিয়ে গেছে। পুরো কার্যালয় ভেঙেচুরে তছনছ করে গেছে।’ দেশের অর্থনীতির বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক দিক থেকে খাদের কিনারায় পড়ে গেছে। দেশ থেকে ব্যাংকের টাকা লুট হয়ে গেছে। তারা বিচারব্যবস্থা দলীয়করণ করে ফেলেছে, যার কারণে বেগম জিয়া মুক্তি পাননি। অন্যায়ভাবে তারেক রহমানকে সাজা দিয়েছে। আজকের সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করছে। যার উদাহরণ ৭ ডিসেম্বর পুলিশ আমাদের পার্টি অফিসে যা করেছে।’ তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পক্ষে আর দেশ চালানো সম্ভব নয়। আজকে দেশের জনগণ শুধু গরিব হচ্ছে। ২০ ভাগ গরিব মানুষের সংখ্যা এখন ৪০ ভাগে গিয়েছে। এ সরকারের এখন বিদায় চায় মানুষ। এ সরকারকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। ১০ দফা দাবি উপস্থাপন করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বলেন, ‘যারা যুগপৎ আন্দোলন করবে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। এখন থেকে বিএনপিসহ সমমনা সব রাজনৈতিক দল এ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবে।’

১০ দফা দাবি : ১. বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। ৩. বর্তমান অবৈধ নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা। ৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি, দেশে সভা, সমাবেশ ও মত প্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা, সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা, স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার না করা। ৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব ধরনের কালাকানুন বাতিল করা। ৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করা। ৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা। ৮. ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত, শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন/দুর্নীতি চিহ্নিত করে অতি দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। ৯. ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা। ১০. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, বেগম খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাসসহ সব কারাবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। সব মিথ্যা, গায়েবি ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আইসিটি মামলা বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম কমাতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির বিচারে কমিশন গঠন করতে হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীন রাখতে হবে।

কর্মসূচি : সমাবেশ শেষে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন ড. মোশাররফ হোসেন। এর মধ্যে রয়েছে- রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও পুলিশের গুলিতে নিহতের প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর দেশব্যাপী গণমিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিজয় র‌্যালি। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে গণসমাবেশ থেকে ঘোষিত ১০ দফা বাস্তবায়নে গণমিছিল। এ কর্মসূচি প্রথমবারের মতো সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎভাবে পালন করবে বিএনপি। গতকালের গণসমাবেশ নিয়ে বিভিন্ন মহলের সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকলেও বিএনপির ডাকা এ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়।

সর্বশেষ খবর