লিওনেল মেসি খেললেন। মনের আনন্দে খেললেন। গোল করলেন। গোল করালেন। আর্জেন্টিনাকে এনে দিলেন অসাধারণ এক জয়। মেসির বাম পায়ের জাদু আর আলভারেজের দূরন্ত গতিতে বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা। স্বপ্ন এখন হাতের নাগালে। মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি উঠবে এবার! আর্জেন্টিনা আক্রমণ করল সংঘবদ্ধভাবে। ওদের ডিফেন্ড করার দৃশ্যগুলোও মুগ্ধ করল দর্শকদের। প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিল অনায়াসেই। এর চেয়ে সহজ কাজ যেন আর নেই! ট্যাকলগুলো দেখে রেফারিও অবাক বনে গেলেন। পারতপক্ষে ফাউল করা লাগলই না! নীল সমুদ্রে ঢেউয়ের উচ্চতা কেবল বেড়েই চলল। সেই ঢেউয়ের তালে তাল মেলাতে না পেরে অসহায় ক্রোটরা ডুবে গেল। গতবার আর্জেন্টিনাকে গ্রুপপর্বে হারিয়েই ফাইনালের পথে ছুটতে শুরু করেছিল ক্রোয়েশিয়া। সেমিফাইনালে তাদের ঠিক ৩-০ গোলে হারিয়েই পাওনা মিটিয়ে দিল আর্জেন্টিনা। মোক্ষম প্রতিশোধ! এমন প্রতিশোধ নিতে দেখে সমর্থকরা উৎসব করল। মেসিরাও ম্যাচটা শেষ করে সেই উৎসবে যোগ দিলেন। ম্যাচসেরার ট্রফি হাতে নেওয়ার আগে উচ্ছ্বাস করলেন। কোচ লিওনেল স্কালোনির চোখ তখন ঝাপসা হয়ে উঠেছে। অশ্রুতে। সেই ঝাপসা চোখেই তিনি স্বপ্ন দেখছেন, বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ‘মেসি, মেসি, মেসি’ কোরাসের সঙ্গে চলছে সম্মিলিত কুর্ণিশ। আর্জেন্টাইন সমর্থকরা এতক্ষণ মেসি-ম্যারাডোনা কোরাস গাইছিল। সেই কোরাসে কিছুটা ভিন্নতা এলো। কিছু সময়ের জন্য ম্যারাডোনাকে বুকে রেখে মেসিকে পিঠে তুলে নিল। শোনা গেল ফুটবলের মহারাজের নামে জয়ধ্বনি। কেবলই মেসি। ম্যাচের ৩৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে ঠান্ডা মাথায় গোল করে মেসিই যে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। কয়েক হাজার লাল-সাদা ডোরাকাটা জার্সি পরা ক্রোয়েশিয়ান সমর্থকদের সাক্ষী মেসি গোলটা করলেন। সোনা রঙের বুট পরে বাম পায়ের শটে বল জালে জড়ালেন। লিওনেল মেসি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জার্সিতে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন (১১ গোল)। ১০ গোল নিয়ে এতদিন শীর্ষে ছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। মেসির গোলটা ঠিকমতো উদযাপন করার আগেই আরও বড় একটা উপলক্ষ এনে দিলেন আলভারেজ। ৩৯ মিনিটে নিজেদের অর্ধ থেকে বল নিয়ে দৌড় শুরু। বাকিটা পথ আলভারেজ ড্রিবলিং করলেন নিরাপদে। ডি বক্সের ভিতরে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার তিনজন ডিফেন্ডার আর গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ান তিনি। আলভারেজের গোলটাই কি বিশ্বকাপের সেরা গোল! এই গোলটার পর পরই ডি বক্সে হ্যান্ডবল হলে পেনাল্টির আবেদন জানায় আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি ভিএআর দেখার অনুরোধও করেন রেফারিকে। কিন্তু রেফারি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আর্জেন্টিনাকে আরও একটি ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট উপহার দেন লিওনেল মেসি। মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার ডি বক্সে ঢুকে কাটব্যাক করেন আলভারেজকে। ফাঁকায় দাঁড়িয়ে সহজেই গোল করেন আলভারেজ (৬৯ মিনিট)। বিশ্বকাপে এটা তার চতুর্থ গোল। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ২২ বছর বা তার কম বয়সী হিসেবে চার গোল করার রেকর্ড কেবল গঞ্জালো হিগুয়েনের (২০১০)। রেকর্ডটা এককভাবে নিজের করে নিতে পারেন আলভারেজ। লিওনেল মেসি বিশ্বকাপে পাঁচটা গোল করার পাশাপাশি তিনটা গোলে এসিস্ট করলেন। গোল্ডেন বলের দাবিটা পাকাপোক্ত করে নিলেন তিনি! গতকাল ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার কৌশলটা ধরতেই যা দেরি, গোল করতে দেরি হলো না আর্জেন্টিনার। সেমিফাইনাল মঞ্চে নাটকের প্রথম অঙ্কটা ছিল ক্রোয়েশিয়ার। দেখে মনে হয়েছিল, এ তো সেই পুরনো ক্রোয়েশিয়া। যারা চার বছর আগে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল মেসিদের। কিন্তু লিওনেল স্কালোনি তখনো পর্যন্ত জাদুর বাকসো খোলার ইঙ্গিতই দেননি! প্রতিপক্ষের ডেরায় আক্রমণ করতে হলে, আগে তাদের মতি-গতি বুঝতে হবে তো! নাটকের পরের অঙ্কগুলো তাই সহজেই মিলে গেল। ল্যাটিনদের বড় আশা ছিল, সেমিফাইনালে হবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ক্ল্যাসিক লড়াই। সে লড়াই দেখার প্রস্তুতিও প্রায় সেরে নিয়েছিলেন সবাই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রোনালদিনহোরা এসেছিলেন গতকাল। আরও অনেক রথী-মহারথীরাই দেখেছেন আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ। ব্রাজিল না থাকলেও আর্জেন্টিনার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন সবাই। ষষ্ঠবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল নিশ্চিত করল আর্জেন্টিনা। এর চেয়ে বেশি ফাইনাল খেলেছে কেবল জার্মানি। ২০১৪ সালে শেষ ফাইনাল খেলেছিল আর্জেন্টিনা। সেবার জার্মানদের কাছে হেরেই শিরোপাবঞ্চিত হয়েছিল আলবেসিলেস্তরা। এবার কি পারবেন মেসি! স্বপ্ন পূরণ করতে!
গতকাল খেলা শুরু হওয়ার তখনো তিন ঘণ্টা বাকি। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা চলছে। বেয়াড়াভাবে বেড়ে ওঠা ঘাসের চোখা মাথা কেটে দিচ্ছেন মাঠ কর্মীরা। ঝকঝকে তকতকে করে দিলেন মাঠটা। গ্যালারি তখনো পুরোপুরি ফাঁকা। হঠাৎ করে প্রায় একযোগে সব গ্যালারিতে কিছু আর্জেন্টাইন সমর্থক প্রবেশ করলেন। আর্জেন্টিনার পতাকা বাঁধতে লাগলেন গ্যালারিজুড়ে। কোথাও স্থান পেলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। কোথাও লিওনেল মেসি। কোথাও আবার একই পতাকায় দুজনেরই স্থান হয়েছে। ম্যারাডোনার মতোই মেসিও আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ ট্রফি উপহার দেবেন, এ আশায় আছেন সমর্থকরা।