রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

অমর্ত্য সেনের বাড়ি নিয়ে ভারতে উত্তেজনা

কলকাতা প্রতিনিধি

নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের বাড়ির জমি নিয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সিরিয়াস হয়ে কেন আক্রমণাত্মক আচরণ করে চলেছে? ইদানীং এ প্রশ্নটি জোরদার হয়ে উঠছে।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় অবস্থিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন তিনবার উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়ে অমর্ত্য সেনকে বলেছে : শান্তিনিকেতন চত্বরে ‘প্রতীচী’ নামে আপনার যে বাড়িটি রয়েছে, তাতে আপনি অতিরিক্ত ১৩ শতক জমি দখল করে রেখেছেন। আইনত আপনার বাড়ির জমি হওয়ার কথা ১ দশমিক ২৫ একর; কিন্তু জমির আয়তন পাওয়া যায় ১ দশমিক ৩৮ একর।

দয়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়তি জমিটি বিশ্বভারতীকে ফেরত দিন। কারণ জমির আইনের প্রয়োগ আপনার জন্য এবং বিশ্বভারতীর জন্যও বিব্রতকর হবে। আপনি জানেন যে, অবৈধভাবে দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারের পদ্ধতিটি জমির সুপ্রতিষ্ঠিত আইন অনুসরণ করে। মূলত ১৩ ডেসিমেল জমি নিয়ে অমর্ত্য সেন ও উপাচার্যকে ঘিরে জমে ওঠা এ বিতর্কে অমর্ত্য সেনের পক্ষেই রয়েছেন আশ্রমিক ও বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীদের একাংশ।

২৬ জানুয়ারি অমর্ত্য সেনের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থী-অধ্যাপকরা। উপাচার্যের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে একাধিক নালিশ করেন তারা। এর পরই বিশ্বভারতীর শিক্ষার মান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের সাসপেন্ড প্রসঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করেন অমর্ত্য সেন। গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জমি বিতর্ক নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগের উত্তর দেন তিনি। অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আইনজীবীর চিঠি (উপাচার্যের কাছে) নিশ্চয়ই যাবে।’ মজার ছলে অমর্ত্য বলেন, ‘দিল্লির কিছু লোকজন আমায় পছন্দ করেন না।’

তাঁর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শুক্রবার জমি ফেরত চেয়ে অমর্ত্য সেনকে ফের চিঠি দেয় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনে অমর্ত্য সেনের আইনজীবীর উপস্থিতিতে জমি জরিপের প্রস্তাবও দেয় বিশ্বভারতী; যা নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বত্র।

বিতর্ক এতটাই চরমে ওঠে যে, অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘অমর্ত্য সেন নোবেল পাননি। অথচ উনি নিজেকে দাবি করেন নোবেলজয়ী। আমি ওনাকে সম্মান করি। তাই বলছি উনি যাতে এ বিষয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করেন।’ উপাচার্যের যুক্তি, আলফ্রেড নোবেলের উইলে অর্থনীতিতে নোবেলের কথা ছিল না, তাই অমর্ত্য সেনকে নোবেল-প্রাপক বলা যায় না।

জবাবে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আমি আদালতে সত্যিই যাইনি। তবে ভয়ে আদালতে যাচ্ছি না, এটা ভেবে থাকলে উপাচার্যের চিন্তাশক্তি নিয়ে ভাববার কারণ আছে। কেন জমি নিয়ে এই কান্ড হচ্ছে, কার মাথায় কী কাজ করছে তা আমি বলতে পারব না।’ তিনি আরও বলেন ‘উপাচার্যের সঙ্গে কেউ কেন আলোচনায় বসেন না, সেটা ওনার ভাবা উচিত।’ ‘নোবেল পদক প্রাপ্তি’ প্রসঙ্গে হেসে ভারতরতেœর জবাব- ‘কেউ যদি দাবি করেন সেটা তার বিষয়। তিনি দাবি করতেই পারেন, আমার কিছু বলার নেই।’ উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আমি খুব উৎসুক। ওঁর সঙ্গে আলোচনা করলে আমার বুদ্ধির বিকাশ হবে। এই যে ওঁর ধারণা, সেই ধারণা নিয়ে চিন্তা করা দরকার, ওঁর সঙ্গে লোকে কেন আলোচনা করতে যায় না।’

এদিকে এ ইস্যুতে লেগেছে রাজনীতির রং। ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি- প্রত্যেকেই মুখ খুলেছে।

বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষের প্রশ্ন- ‘জমি-সম্পত্তির ওপর অমর্ত্য সেনের এত লোভ কেন?’ পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরে দলীয় অনুষ্ঠানে দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘অমর্ত্য সেন যে নোবেল পাননি সেটা আগেই জানিয়েছিলাম। কারণ অর্থনীতিতে নোবেল হয় না। উনাকে ঘিরে বিতর্ক শেষ হয় না। যেগুলো না হওয়াই ভালো। অমর্ত্য সেনের মতো লোক বাঙালির কাছে উদাহরণ। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি দখল করে নিয়েছেন বলে লোক অভিযোগ করবে সেটা কি সম্মানজনক? উনি নিয়েছেন কি না সেটাও পরিষ্কার করে বলছেন না কেন? যদি নিয়ে থাকেন তাহলে ছেড়ে দিন। জমি নিয়ে কি উনি ওপরে যাবেন? এই বয়সে জমি-সম্পত্তির ওপর মানুষের মোহ কেটে যায়। উনার এত মোহ কেন?’

বিজেপির সংসদ সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘বিশ্বভারতী তাদের জমি উদ্ধার করার জন্য অমর্ত্য সেনকে নোটিস দিয়েছে। এটা নিয়ে রাজনীতির করার দরকার নেই। এটা তো অমর্ত্য সেনের ব্যক্তিগত মামলা।’

অন্যদিকে গতকাল হাওড়া পুরসভায় এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে পশ্চিমবঙ্গের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম উপাচার্যকে ‘পাগল’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘উপাচার্য যা করছেন তাতে অমর্ত্য সেনের অপমান নয়, সারা বাংলার অপমান। আসলে অমর্ত্য সেন বিজেপির মতের সঙ্গে একমত হতে পারেননি বলে এই আচরণ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে খুশি করার জন্যই বিশ্বভারতীর উপাচার্য এ কাজ করছেন।’

প্রসঙ্গত, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন অমর্ত্য সেনের পিতামহ পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন। সে সময় তাঁকে বসবাসের জন্য আশ্রমসংলগ্ন সুরুল মৌজায় একটি জমি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ক্ষিতিমোহনের নাতির নাম ‘অমর্ত্য’ নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

সর্বশেষ খবর