ডলারের দাম বৃদ্ধি, কভিডকালীন নানামুখী বিপর্যয়ে গত এক বছরে ব্যবসায়ীদের ৬৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন বছর আগে এক ডলারের দাম ছিল ৮২ টাকা। সেই ডলার এখন ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ব্যাংকে। ওই সময়ে যারা এলসি খুলেছিলেন দায় পরিশোধে তাদের এখন বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সংকট উত্তরণের জন্য ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। আর জ্বালানি সংকট সমাধানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে দেশের আর্থিক হিসাবে ১ হাজার ৪০৬ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আর্থিক হিসাবে উল্টো ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এ মনসুর বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় গত এক বছরে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর ৬৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিন বছর আগে ১০০ ডলার ৮ হাজার ২০০ টাকায় কেনা গেলেও গত এক বছরে ব্যবসায়ীরা ১০০ ডলার ১০ হাজার ৫০০ টাকায় কিনছেন। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অনেক কোম্পানির লোকসান হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকায়। ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমেছে ৯০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ।
ডলারের দাম ফিক্সড থাকলে ঝুঁকি মূল্যায়নটা হয় না। ডলারের দাম নির্ধারিত হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতিটা হয়েছে। অর্থনীতি যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, মানুষ বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করতে পারে সে জন্য অবিলম্বে ডলার সংকট সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যমান ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ডলারের দাম ওঠানামার সুযোগ দিলে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি মূল্যায়ন করার সুযোগ পান। বাজারভিত্তিক হলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো ডলারের দাম মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন- কে বিদেশি ঋণ নেবে আর কে নেবে না। তিনি আরও বলেন, জ্বালানির দাম সরকার নির্ধারণ না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে পারে। এখন তো দাম মোটামুটি বাজারের কাছেই চলে এসেছে। কাজেই এখন বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ছেড়ে দিতে পারে। তাহলে আর ভর্তুকিও দিতে হবে না। হঠাৎ করে অনেক বেশি দামও বাড়াতে হবে না। প্রতি মাসে, প্রতি সপ্তাহে কিছু কিছু বাড়বে-কমবে। চাল-গমের দাম যেভাবে বাড়ে, সেভাবে জ্বালানির দাম বাড়বে-কমবে। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন অর্থনীতির সংকট মানে ডলার। একে ছোট করে দেখার কিছু নেই। এই সংকট প্রকট হলে মারাত্মক পরিস্থিতি ধারণ করবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কভিড পরবর্তী সময়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের উচ্চমূল্য ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি করেছে। এই ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে আল্লাহ জানে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও আমরা চাহিদা মতো পাচ্ছি না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু দাম বাড়ালেই হবে না, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করতে হবে। শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকলে ৪০ লাখ মানুষ বেকার হবে।’ তিনি আরও বলেন, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য শুধু দাম বাড়ালেই হবে না। সিস্টেম লস ও অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে হবে। তাহলে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গ্যাস শিল্পে সরবরাহ করতে পারবে সরকার। ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য আরও কমিয়ে আনতে হবে। এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি আমাদের আমদানি-রপ্তানিতে ডলারের বিনিময় মূল্যের পার্থক্য ২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেটা কার্যকর হলেও অনেক লোকসান কমানো সম্ভব হবে।
ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর ভাইস প্রেসিডেন্ট আমিন হেলালী বলেন, আমাদের অর্থনীতির আকার এখন অনেক বড়। কভিড পরিস্থিতির উন্নতি হতে না হতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আমাদের আশ্বস্ত করেছেন শিগগিরই ডলারের বিনিময় হারে একটা স্থিতিশীলতা আসবে। সেটা হলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি কমে আসবে।