মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

চীনও চাইছে সেপা

♦ অর্থনৈতিক অংশীদারি নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই ♦ নীতিনির্ধারণী বৈঠকের প্রস্তাব বাণিজ্যে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চীনও চাইছে সেপা

ভারতের পর এবার চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিবিষয়ক সেপা (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) করতে চাইছে। চুক্তি এগিয়ে নিতে দুই দেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছে। এমন কি চুক্তির কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শুরু হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের দুই বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত ও চীন। ভারতের সঙ্গে যেহেতু সেপা চুক্তির বিষয়ে নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত রয়েছে, তাই চীনের ক্ষেত্রেও সরকার ইতিবাচক। তা ছাড়া ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর প্রচলিত বাজার সুবিধা আর থাকবে না। সে সময়ের কথা বিবেচনা করে এখন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য চুক্তির (পিটিএ, এফটিএ, সেপা) আলোচনা এগিয়ে নিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা রয়েছে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। চীনের সঙ্গে সেপার বিষয়ে আলোচনা সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সেপা চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর বিষয়ে চীনের পক্ষ থেকে তাগিদ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে বৈঠকও করেছেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও উইয়েন। সূত্রটি জানায়, তারিখ নির্ধারিত না হলেও মার্চের মধ্যে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যবিষয়ক একটি বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শুল্ক সুবিধার পরও বাড়েনি রপ্তানি : বাংলাদেশ এবং চীন উভয়ই এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (আপটা) সদস্য। আপটার সদস্য হিসেবে স্থানীয়ভাবে মূল্য সংযোজনের শর্তে চীনে ৮৩টি পণ্যে এবং ডব্লিউটিও-এর আওতায় আরও প্রায় ৫ হাজার পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে চীন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জিরো ট্যারিফ স্কিম ঘোষণা করে বাংলাদেশকেও ওই স্কিমের সুযোগ নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তবে বাংলাদেশ যেহেতু আপটায় প্রায় ৬০ শতাংশ পণ্যে বাজার সুবিধা পেয়ে আসছিল, সে কারণে প্রথমদিকে ওই সুবিধা গ্রহণ করেনি। পরে ২০১৯ সালে চীন আবারও ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়। এবার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলাদেশ। পরে ২০২০ সালের ১৬ জুন শর্তহীনভাবে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ রপ্তানি পণ্য (৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য) দেশটির বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয় চীন, যা ওই বছরের ১ জুলাই কার্যকর হয়। এরপর ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশ আরও ১ শতাংশ পণ্যকে (৩৮৩টি) শুল্কমুক্ত সুবিধার ঘোষণা দেয় দেশটি, যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। কিন্তু এসব সুবিধার পরও দেশটিতে রপ্তানি বাড়েনি। বরং আগের বছরের তুলনায় পণ্য রপ্তানির পরিমাণ আরও কমে গেছে। ইপিবি ও এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিপরীতে বাংলাদেশে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮৮৮ মিরিয়ন ডলার। ওই সময় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাঁচ বছর পর এই বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়েছে, উপরন্তু চীনের বাণিজ্য বাড়লেও কমেছে বাংলাদেশের রপ্তানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে ৬৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে, যেখানে চীনের রপ্তানি বেড়ে ২৬ হাজার ২৫৩ মিলিয়ন ডলারে ওঠে। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ২৫ হাজার ৫৬৯ মিলিয়ন ডলারে উঠে যায়। ইপিবির সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে দেশটিতে মাত্র ৩৭০ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৫ দশমিক ২৮ মিলিয়ন। আগের অর্থবছরের একই সময় দেশটিতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪২৬ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে, ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার পর দেশটিতে প্রায় ১৩ শতাংশ পয়েন্ট রপ্তানি কমেছে বাংলাদেশের। শুধু তাই নয়, বৃহত্তম এই বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। দ্বিপক্ষীয় এই বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং আফ্রিকা সফরকালে ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেন। ওই সময় সংক্ষিপ্ত বৈঠকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়ে ছিন গ্যাংকে অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে ঘোষণা দিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন মোমেন। ২ ফেব্রুয়ারি চীনের রাষ্ট্রদূত দেখা করতে এলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও একই স্বরে কথা বলেন। ওই সময় টিপু মুনশি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান অনেক বেশি। দেশটিতে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। জবাবে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও উইয়েন বলেন, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আগামীতে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ আরও বাড়বে। এই বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দ্বিপক্ষীয় সেপা চুক্তিই যে বড় হাতিয়ার হতে পারে- সে ইঙ্গিতই দেশটির পক্ষে রাষ্ট্রদূত দিয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর