বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাষাসংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হোক সবাই

মোহন রায়হান

ভাষাসংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হোক সবাই

ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের চেতনা উল্টো পায়ে হাঁটছে। কারণ ভাষা আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

বাংলা ভাষার আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ বেয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বটে কিন্তু সে রাষ্ট্রে কি বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? বুকে হাত দিয়ে আমরা কি কেউ বলতে পারব? বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা চালু হয়নি। বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ভাষার ক্ষেত্রেও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। দেশজুড়ে ইংরেজি স্কুলের ছড়াছড়ি। পাবলিক স্কুল কলেজ বিদ্যালয়গুলোতে নামমাত্র শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা হলেও প্রকৃত অর্থে এগুলোয় পুরোপুরি বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অফিস আদালতে কোথাও পূর্ণ মাত্রায় বাংলা ভাষার ব্যবহার হয় না। বেসরকারি কোনো অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই যেখানে পূর্ণমাত্রায় বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আইন এবং আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধান থাকলেও পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার আইন ভঙ্গের অপরাধে একজন ব্যক্তিকেও আজ পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ কিংবা ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর’ এই দাবিতে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, বলা যায় সে আন্দোলন পূর্ণাঙ্গ সফল হয়নি, এমনকি ভাষা আন্দোলনের চেতনা ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করেছে। যে জাতি বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছে, সে জাতির বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা, বাংলা ভাষা সর্বক্ষেত্রে সব সময় ব্যবহার করা, অস্তিত্বের গর্বের এবং অহংকারের হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুঃখজনক বিষয় এই যে, হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান, শিক্ষা গ্রহণ, সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার আজ এ জাতির লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজি ভাষায় কথা বলা, শিক্ষা দান বা গ্রহণ, সর্বকাজে মাতৃভাষার মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের পারঙ্গমতা যেন আজ অতি গর্বের, অতি অহংকারের, অতি যোগ্যতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণটা কী? কারণটা হচ্ছে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জনগণের হয়নি। সেটি হয়েছে কতিপয় উচ্চাভিলাষী ধনীক বণিক বুর্জোয়া লুটেরা শ্রেণির। যাদের মাতৃভাষা এখন ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ব্যাংক লুট, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা। আর তারা তাদের এই অপকর্মের হাতিয়ার হিসেবে চৌর্যবৃত্তি, ডাকাততন্ত্র, লুটমন্ত্রের উত্তরাধিকার তৈরি করার জন্য নিজেদের সন্তানদের মাতৃভাষার বদলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে মুখিয়ে থাকে। শুধু অর্থ পাচার নয়, মেধার পাচারেও এই দস্যুদল অপূর্ব জাদু বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করেছে। মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা, রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষা আজ তাই এতটা উপেক্ষিত, অবহেলিত, তুচ্ছ, নুলো, ঠুঁটো ভিখারি সম। মহান ভাষা-সংগ্রামের প্রেরণার মাসে, আমাদের মেধা-মনন, হৃদয়-চেতনা আর বিবেকে সেই অগ্নিমন্ত্র উজ্জীবিত করাই হবে ভাষা শহীদ, ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন।

লেখক : কবি

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর