ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যে ভাষা মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে, শোষক গোষ্ঠী তাদের অপশাসনকে দীর্ঘায়িত করতে সেই বাংলা ভাষার টুঁটি চেপে ধরে। কোনো জাতিকে দমিয়ে রাখতে, দাসত্বের শৃঙ্খলে পরাভূত করে রাখতে প্রথম আঘাত করা হয় ভাষার ওপর, আধিপত্য বিস্তারে ভাষার হেজিমনি শক্তিকে কাজে লাগায় শাসকরা। পশ্চিম পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র যখন এমন কূটচালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কথা বলার শক্তি কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করে উর্দু ভাষার দাস বানাতে চেয়েছে, তখন এর অনিবার্য পরিণতি গড়ায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে। দীর্ঘ চার বছর ভাষা সংগ্রামের আন্দোলন চালিয়ে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে বাঙালি জাতি। মাতৃভাষার এ আন্দোলন পরবর্তীতে জাতিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে। তাই বাঙালি জাতিসত্তা, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ও একটি স্বাধীন পতাকার মূল তাৎপর্য নিহিত রয়েছে মূলত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে- তথা ভাষার পরাধীনতা থেকে মুক্তির আন্দোলনে।
কিন্তু ভাষা সংগ্রামের একাত্তর বছর পরও ভাষা কি পেরেছে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে? আমরা কি পেরেছি বাংলা ভাষার সার্বজনীন স্বকীয়তা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে? এ ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের অহংকার ও গৌরব, যার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। অথচ পরিতাপের বিষয়, আজও দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যায়নি। আসলে ভাষার ওপর যখন আঘাত আসে, ভাষাশক্তি যখন বিপন্ন হয়, তখন এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিতে আসে। এ জন্যই আমরা ’৫২ সালে ভাষার স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলাম। একটি পরাশক্তি তাদের শাসনকাঠামো পোক্ত করতে আমাদের ওপর তাদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, সেই শঙ্কাকে আমরা জয় করেছিলাম। কিন্তু এখন আমরা স্বাধীন জাতি, স্বাধীন আমাদের রাষ্ট্রের কাঠামো, তবুও কেন আমাদের ভাষা সর্বত্র অবহেলিত? বর্তমানে অবস্থাটা এমন যে সর্বত্র একটি প্রবাদ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, ‘বাংলার ভাত নেই’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিভাগ রয়েছে, সেখান থেকে শত শত গ্র্যাজুয়েট পাস করে বের হচ্ছে, অথচ বাংলা ভাষা তার মর্যাদার সংকট ঘোচাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগে ধনকুবেরের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে ভুল বাংলা বলত, এখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ভুল বাংলা পড়ে ও লিখে। উপরন্তু নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পড়ার মাধ্যম ইংরেজি করায় এর পরিণতি হয়েছে আরও ভয়াবহ। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ কর্পোরেট বাজার দখলে নিতে বাংলাবিমুখ হয়েছে। সরকার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলার প্রায়োগিক ব্যবহার উপেক্ষিত থেকেই যাচ্ছে, অন্যদিকে ভিনদেশি ভাষা ইংরেজির আধিপত্য সর্বগ্রাসী হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক বাংলা শব্দ। সেখানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে অন্য ভাষার শব্দ। দেশের উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে উচ্চবিদ্যায়তন, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিরীক্ষা করলেই এ ত্রুটির অকাট্য প্রমাণ মিলবে। রুঢ় বাস্তবতা এই যে বাংলা ভাষা আজও আমাদের ভালোবাসা বঞ্চিত। ভাষার মাস ফাল্গুন। বছরের এ মাসেই শুধু ভাষা নিয়ে আমাদের জাতীয় আবেগে বিশেষ ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। তাই আমরা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রভাতফেরি, পদযাত্রা, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, সভা-সমাবেশ, বুদ্ধিজীবী টকশো ও গোলটেবিল বৈঠক করি, এরপর আবার যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকে। তাই শুধু অনুষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, ভাষাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে, ভাষা অধ্যয়নকে শিক্ষাতত্ত্ব ও পেশাগত প্রয়োজন এবং গুরুত্বের নিরিখে বিবেচনায় আনতে হবে। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে জ্ঞান অর্জনের জন্য ইংরেজি চলতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রধান ভাষা বাংলা এবং অবশ্যই বাংলা- এ সত্যের অপলাপ চলতে দেওয়া সমীচীন না। আমাদের মনে রাখা জরুরি বাংলা ভাষার পঠন-পাঠনে নাসিকা কুঞ্চিত করা, দৃষ্টি উচ্চকিত করার অর্থ নিজ ভাষাকেই পরাধীন করা, বাংলাকে আঘাত করা মানে নিজেরাই আত্মহননের পথে ধাবিত হওয়া।
লেখক : উপাচার্য, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।