সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়াবহ আগুন গুলশানে

লাফিয়ে একজন নিহত, আহত ১৫ ♦ রুদ্ধশ্বাস চার ঘণ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়াবহ আগুন গুলশানে

গুলশানে আবাসিক ভবনে আগুন নেভানোর চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। উদ্ধার করা হয় এক শিশুকে। বারান্দায় অবস্থান বাসিন্দাদের -রোহেত রাজীব

রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে একটি ১২ তলা ভবনের সপ্তম তলায় ভয়াবহ আগুন লাগে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে এ আগুনের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট পর্যায়ক্রমে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টার মধ্যেই আগুন ওপরের তলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ৪ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই ভবন থেকে মোট ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে পুরুষ ৯ জন, মহিলা ১২ জন ও শিশু একজন। ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে অন্তত ১৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের জয়নুল হক শিকদার হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর আনোয়ারুল ইসলাম দোলন বলেন, গুলশান-২ নম্বরের ব্লক-সেন্ট্রাল জি, রোড-১০৪ এর ২ নম্বর বাড়ির সপ্তম তলায় আগুন লাগে। খবর পেয়ে ৭টা ১০ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। এরপর আরও দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে অগ্নিনির্বাপণে পাঠানো হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় আরও ১৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। আমরা মইয়ের মাধ্যমে ১২ জন নারী, ৯ জন পুরুষ ও একজন শিশুকে জীবিত উদ্ধার করেছি। রাত পৌনে ১১টার দিকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ভবনের ভিতরে তল্লাশি করা হয়। ৪ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় একজন নিহতসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

এদিকে, গুলশানে বহুতল ভবনে আগুনের ঘটনায় আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছে বলে জানায় আইএসপিআর। আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসে বিমানবাহিনীর পাঁচটি ইউনিট। এসব ইউনিটের নেতৃত্বে থাকা বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোমিনুল ইসলাম বলেন, খবর পাওয়ামাত্রই বিমানবাহিনীর পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসেছে। আমরা আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসকে সাহায্য করছি। এ ছাড়া ভিতরে আটকেপড়াদের উদ্ধারের জন্য একটা হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলে এসেছে। পুলিশ-র‌্যাবও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। তারা উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। স্থানীয়রা বলছেন, গুলশানের মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে একটি ১২ তলা ভবনে সন্ধ্যায় আগুন লাগে। ওই ভবনসহ আশপাশের ভবনে আগুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে আশপাশের ভবন থেকে লোকজন দ্রুত নিচে নেমে এসে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নেন। আগুন লাগা ভবনে অনেকে আটকে পড়েছেন। ওই ভবন থেকে কয়েকজন লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন। লাফ দেওয়ার সময় তাদের গায়ে আগুন জ্বলছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মইয়ের মাধ্যমে ভবন থেকে কয়েকজনকে নিচে নামিয়ে এনেছেন। ভবনে লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। সরেজমিন দেখা গেছে, সপ্তম তলায় লাগা আগুন ক্রমেই ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণে কাজ করে। আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী। ১১ তলা পর্যন্ত উঠলেও আগুনের তীব্রটা কিছুটা কমে যায়। তবে ধোঁয়া অনেক, এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের কাজ করতে বেগ পেতে হয়। ঘটনাস্থলের পাশে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স ছিল। ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সপ্তম তলায় আগুন লাগলেও তা ১১ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে বসবাসকারীরা বলছেন, অনেকেই ভবনের ভিতর আটকে পড়েছিলেন। রাত ১০টার দিকে ওই ভবনের নিচে থাকা সুলেমান চৌধুরী নামের একজন জানান, তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফোন দিয়ে জানিয়েছেন, ?ভাইয়া আমি ১১ তলায় আটকে পড়েছি। আমার সঙ্গে আরও মানুষ আছে। দ্রুত লোক পাঠিয়ে আমাদের বাঁচান, প্লিজ। তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ভবনটির পাঁচ তলায় থাকেন। সঙ্গে তার স্বামীও থাকেন। কিন্তু তার স্বামী বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী পেশায় একজন চিকিৎসক। সুলেমান চৌধুরী আরও বলেন, কিছুক্ষণ আগে ফোন করে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জানান, আগুন লাগার সময় তিনি বাসায় পঞ্চম তলায় ছিলেন। আগুন লাগার পর ধোঁয়ার কারণে নিচে নামতে পারেননি। জীবন বাঁচাতে ওপরে চলে গেছেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে মনির নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, তার তিনজন আত্মীয় ভবনটির ১১ তলায় আটকে আছেন। ভিতরে আগুন ও ধোঁয়ার কারণে তারা বের হতে পারছেন না। গুলশান থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমিনুল ইসলাম বলেন, আবাসিক ওই ভবনে অনেক পরিবার বসবাস করে। ভবন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। ভবনের বিভিন্ন তলায় অনেকে আটকে পড়েন। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়। আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধার তৎপরতা তদারকি করেন। এ সময় ডিএনসিসি মেয়র হ্যান্ড মাইক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে কাজের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান এবং পুলিশকে ঘটনাস্থল থেকে সবাইকে সরানোর জন্য নির্দেশ দেন। মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ভবনের বাসিন্দাদের বারবার বলেছি আপনারা লাফ দিয়েন না। একটু ধৈর্য ধরুন। যারা লাফ দেননি তাদের নিরাপদে নামিয়ে আনা গেছে। আর যারা লাফ দিয়েছেন তারা কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের উদ্ধার করে মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। সরেজমিন আরও দেখা গেছে, আগুন জ্বলছিল। ভবন থেকে প্রচ- ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ভবনের আশপাশে হাজারও উৎসুক জনতা। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস। উৎসুক জনতাকে লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে পুলিশ। অনেক উঁচুতে আগুন লাগায় পানি দিতে বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন থেকে ভবনের ওপরে লাগা আগুন পর্যন্ত পানি যাচ্ছিল না। আশপাশের ভবন ও গুলশান লেক থেকে পানি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিস। ভবনের নিচের ফ্লোরসহ বিভিন্ন ফ্লোরে লোকজন আটকে পড়েন। তারা মোবাইল ফোনের লাইট জ্বালিয়ে উদ্ধারের জন্য ইশারা করছিলেন। ভবন থেকে পোড়া কাগজ উড়ে আসছিল। ভবনের ভিতরে আটকেপড়া কয়েকজন আগুন আতঙ্কে নিচে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত পুরুষের বয়স ৩৮ বছর। আগুন লাগার পরপর ওই এলাকার বৈদ্যুতিক লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আশপাশের ভবনে বৈদ্যুতিক লাইন দেওয়া হয়। ওই ভবনের ১২ তলায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন রিনা আক্তার। তিনি জানান, ফ্ল্যাটটি ফাহিম সিনহার। তিনি একমি ওষুধ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঘটনার সময় আমি ১২ তলায় ছিলাম। হঠাৎ করে বাবুর্চি বলেন ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, সবাই আগুন আগুন বলে চিৎকার করছেন। আমরা তাড়াহুড়ো করে লিফট দিয়ে নামি। আমার ম্যাডাম (শ্যামা রহমান) ফ্ল্যাট থেকে বের হতে পারেননি। তিনি লাফ দিয়েছেন দেখলাম। তার কী খবর আমরা জানি না। আমরা কোনোমতে প্রাণে বেঁচে এসেছি। রাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসছে। এখন আগুন নেই। অত্র এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সবকিছু আমাদের কন্ট্রোলে আছে। আমরা জনগণকে বলব আপনারা আমাদের একটু কাজ করার সুযোগ দেন।  ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, অগ্নিকান্ডে আহত চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের মধ্যে তিনজন দগ্ধ হয়েছেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আমাদের ফায়ার ফাইটাররা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করেছেন। তারা এখন উদ্ধারকাজ করছেন। ভবনের প্রতিটি তলায় পরীক্ষা করবেন। কেউ আটকে আছে কি না সেগুলো দেখা হচ্ছে। আটকে থাকলে তাদের উদ্ধার করা হবে। আগুন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে পানির ব্যবস্থা ছিল না। ফলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে কিছুটা সময় লেগেছে। আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

এদিকে, দায়িত্ব পালনের সময় দৈনিক কালের কণ্ঠের সাংবাদিক জহিরুল ইসলামকে গুলশান থানার এসআই হাসিব মারধর করে বলে অভিযোগে জানা গেছে। পরে বিষয়টি ডিএমপির গুলশান বিভাগের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলামকে জানান সাংবাদিক জহিরুল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর