দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে ভোটের হিসাবনিকাশ। আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন ৩ কোটির বেশি তরুণ ভোটার। যাদের বসয় এখন ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে হওয়া নতুন ভোটাররাই আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছেন। ১৮ থেকে ২৯ বছরের এসব ভোটারের সমর্থনেই ঠিক হবে ক্ষমতায় বসবে কোন দল। তাই তরুণ ভোটারের চিন্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ভাবনা শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সেভাবেই তৈরি হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনের ইশতেহার। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নেও এবারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে তারুণ্যকে। এদিকে আজ পঞ্চমবারের মতো সারা দেশে পালিত হবে জাতীয় ভোটার দিবস। এবার ভোটার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘ভোটার হব নিয়ম মেনে, ভোট দেব যোগ্যজনে’। সেই সঙ্গে আজ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। সে তালিকা দিয়ে অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখন সারা দেশে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯০ লাখের বেশি। আজ ইসি নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য প্রকাশ কবে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে, দেশের ১৮ থেকে ২৯ বছরের ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ২৪৪; তারা দেশের মোট ভোটারের প্রায় ২৫.৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৭ হাজার তরুণ এবারই প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন। যারা দেশের মোট ভোটারের ১৬ শতাংশের বেশি। এ কারণে তারাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। এ ছাড়া ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনের পর থেকে গত ১৪ বছরে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ৩ কোটি ৭২ লাখ ৫২ হাজার ৮১৫ জন তথা ৩২.৭৭ শতাংশ; তাদের বয়স এখন ১৮ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গত ১ মার্চ পর্যন্ত খসড়া হিসাবে দেশে ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৯১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৮ জন। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী ৮৪৬৫২৫৫ জন। ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সী ১১২২২৫৪৮ জন। ২৬ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১১১২৫৩৪১ জন। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটার ১০৩২৪১৭৮ জন। ৩৪ থেকে ৩৭ বছর বয়সী ভোটার ১৪৪৩২০১৩ জন। ৩৮ থেকে ৪১ বছর বয়সী ভোটার ১২২০৮২০৫ জন। ৪২ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ভোটার ১০৬২৮৫১৬ জন। ৪৬ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ভোটার ৬৩৬৫০৬৭ জন। ৫০ থেকে ৫৩ বছর বয়সী ভোটার ৮২৬৯৯৮৫ জন। ৫৪ থেকে ৫৭ বছর বয়সী ভোটার ৬৭০৪৪৬৫ জন। ৫৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ভোটার ৩৯৮০৫২৮ জন এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী ভোটারের সংখ্যা ১৭৭৯৫২৭৮ জন। ইতোমধ্যে সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শেষ হয়েছে। আজ নতুনদের যুক্ত করে এবং মৃতদের বাদ দিয়ে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে ইসি। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত নবম সংসদ নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের আমরা তরুণ ভোটার হিসেবেই বিবেচনা করতে পারি। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর থেকে ১৪ বছরে দেশে ভোটার বেড়েছে ৩ কোটি ৮১ লাখ ৮ হাজার ৬৫ জন তথা ৩১.৯৭ শতাংশ; ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনের সময় দেশে ভোটার ছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩ জন। বর্তমানে খড়সা ভোটার ১১ কোটি ৯১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৮ জন। নির্বাচনে তরুণ ভোটারের প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ভোটগুলো মূলত দু-তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সেই ধারাবাহিকতা চলে আসছে, খুব বেশি হেরফের হয় না। তবে নতুন ভোটারের ক্ষেত্রে হেরফের হয়, এটা নির্ভর করে কোন দল, কত বেশি তরুণ ভোটার আকৃষ্ট করতে পারে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে। দেশের প্রধান দুই দলের ভোটের হারেও খুব বেশি তফাত নেই। তাই নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন।’
ভয়ভীতিহীন নির্বাচন করতে চায় ইসি : আহসান হাবিব খান
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, ভয়ভীতিহীন নির্বাচন ও নির্বিঘ্ন পরিবেশ করতে নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ তৎপর। নিজেদের মেয়াদের প্রথম বছরে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তাতে যেখানে বাধা, অনিয়মের অভিযোগ এসেছে সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আজ জাতীয় ভোটার দিবস-২০২৩ উপলক্ষে গতকাল তিনি গণমাধ্যমের কাছে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত বর্তমান ইসির অধীনে পাঁচ শতাধিক নির্বাচন হয়েছে; যার সিহংভাগই ইভিএমে। এসব ভোটে নির্ভরযোগ্য কোনো অভিযোগ তো আসেইনি এবং সংক্ষুব্ধ কেউ আদালতেও দ্বারস্থ হয়নি। ইভিএমের নির্বাচনে ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া প্রসারিত করেছে। নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের গোপন কক্ষে অবাঞ্ছিত লোকের উপস্থিতি ও কেন্দ্রে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
সব দলকে ভোটের আসার বিষয়ে ইসির আহ্বান বরাবরই অব্যাহত থাকে জানিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটাধিকার মুখের কথা নয়, এটাকে অর্থবহ করতে আমাদের সব ধরনের উদ্যোগ, সর্বোচ্চ সদিচ্ছা থাকবে। আমরা চাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনসহ সব নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক’।
তিনি বলেন, ভোটাররাও উৎসবমুখরভাবে কেন্দ্রে আসবেন, নিরাপদে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ঘরে ফিরে যাবেন। ‘ভোটার দিবসেই শুধু নয়, আমরা সব সময় আশ্বস্ত করতে চাই-আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে পালন করব। পাশাপাশি সবার সহযোগিতাও কামনা করি। ভালো নির্বাচনও উপহার দিতে সক্ষম হব।’ সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা আশ্বস্ত করেন, ভোটে আসেন সবাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক। গোলযোগ, সহিংসতা পরিহার করতে হবে; নির্বাচন কমিশনও অনিয়ম ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে ভোটের মাঠেও ভারসাম্য থাকবে। ভোটে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে।
ভোটার, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা, নির্বাচনী এজেন্ট, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের ‘সেফটি’র বিষয়ে কমিশন বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আমরা সারা বছরই ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছি। হালনাগাদে নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরেও সারা বছরই যোগ্যরা ভোটার হতে পারছেন। ভোটার হওয়ার পাশাপাশি তাদের এনআইডি সেবাও সহজীকরণে সব ধরনের পদক্ষেপ রয়েছে। প্রত্যেক ভোটারের নাগরিক অধিকার তার ভোটাধিকার। এ অধিকার রক্ষায় আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি এবং তা অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশন শুধু ভালো নির্বাচন করব; কিন্তু যিনি বা যারা পরাজিত হবেন তিনি বা তারা সমালোচনায় মুখর হবেন তা সমীচীন নয়। নির্বাচনের গুণগত সংস্কৃতির বিকাশে ভোটার, দল, অংশীজনসহ সবার সহযোগিতা দরকার। ভোট নিয়ে কল্পনাপ্রসূত কোনো শঙ্কার বশবর্তী হয়ে নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতিও কাক্সিক্ষত নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সব রাজনৈতিক দল ইসিকে আস্থায় নেওয়া উচিত : ইসি আলমগীর
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আলমগীর বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। আমাদের পক্ষ থেকে যত রকম ব্যবস্থা নেওয়া দরকার নির্বাচন কমিশন থেকে আমরা নেব। পার্টিসিপেটরি নির্বাচন হবে বলে আমরা মনে করি। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলের আমাদেরকে আস্থায় নেওয়া উচিত। কারণ আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন করেছি। কেউ বলতে পারবে না যে, আমরা কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছি। প্রত্যেকটা নির্বাচনই আমরা সুষ্ঠুভাবে করার চেষ্টা করেছি।
ভোট পড়ার হার কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেগুলোর নানারকম পরিস্থিতি ছিল। একটি বড় রাজনৈতিক দল কোনো নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করছে না। স্বাভাবিকভাবেই তাদের যারা সাপোর্টার তারা তো ভোট দিতে আসেন না। এ জন্য ভোটের কাস্টিং কমে যাচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে করোনার মধ্যে আমাদের কিছু নির্বাচন করতে হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে তখন অনেকে ভয়ে ভোট দিতে আসেননি। এ ছাড়া উপনির্বাচনগুলো যখন হয়, উপনির্বাচনের মেয়াদ থাকে অল্প এবং এতে সরকারের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই ভোটদানে আগ্রহ কম থাকে। সামনের যে জাতীয় নির্বাচন হবে সে নির্বাচনে কিন্তু সরকার পরিবর্তন হতে পারে। সেই সুযোগ যেহেতু এখানে রয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যে দলকে ভোট দেবে, সেই দল সরকার গঠন করবে। তো সেক্ষেত্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। যারা নির্বাচনে আসছে না তাদের নির্বাচনে আনার জন্য শেষ পর্যন্ত আপনাদের কোনো ভূমিকা থাকবে কি-না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো আছে, শেষ পর্যন্ত থাকবে। বুঝতে হবে আমাদের ভূমিকাটা কী। আমরা আশাও করি যে, সবদল নির্বাচনে আসবে। কারণ আমাদের কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করা। আমরা যদি নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করি, তাহলে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসবে। ভোটার দিবসের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৮ সাল থেকে আমরা এটি করে আসছি। আগে ১ মার্চ এ দিবসটি পালন করা হতো। এখন ২ মার্চ পালন করা হয়। এদিন যারা আগের ভোটার আছেন, যারা মারা গেছেন তাদের নাম কাটা, নতুন ভোটার হয়েছেন এটি হিসাব করে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে কত ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তা এদিন জানতে পারবেন।