মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে বিলাসী জীবন

♦ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা দুবাইয়ে পাচার বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও টেরাকোটা টাইলসের ♦ অর্থ উদ্ধারে খেলাপিদের আইনের আওতায় আনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

শাহেদ আলী ইরশাদ

ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে বিলাসী জীবন

ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা মেরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন কতিপয় ব্যবসায়ী। বছরের পর বছর ব্যাংকের খাতায় ঋণখেলাপি দেখানো হলেও তারা বিদেশে রাজকীয়ভাবে বসবাস করছেন। ক্রিসেন্ট গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বড় অংশই পাড়ি জমিয়েছেন দুবাইয়ে। সেখানে গড়ে তুলেছেন আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা। কিনেছেন বিলাসবহুল গাড়ি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। খেলাপি প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে। বিচার বিভাগকে শাস্তি নিশ্চিত করে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংক খাতে আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি। গ্রুপটি ছয়টি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেনি। বরং গ্রুপটির এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার ঋণ পরিশোধ না করে রাতারাতি পাড়ি জমান বিদেশে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। পরে ভুয়া এলসির মাধ্যমে পুরো অর্থই বিদেশে পাচার করে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। ফলে খাজা সোলায়মানসহ এর বেশির ভাগ শীর্ষ নির্বাহী বিদেশে পালাতক রয়েছেন। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার ও চেয়ারম্যান নওরিন হাবিবসহ গ্রুপের কিছু কর্মকর্তা এখন দুবাইয়ে বসবাস করছেন। সেখানে তারা একটি অভিজাত হোটেলের ব্যবসা করছেন।

ভুয়া রপ্তানি নথিপত্র তৈরি করে সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। অপকর্মে সহায়তা করার পাশাপাশি ক্রিসেন্ট গ্রুপকে অর্থায়নও করেছে ব্যাংক। ক্রিসেন্টের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে গ্রুপটি ব্যাংক ও সরকারের তহবিল থেকে নিয়েছে ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। কাগজে-কলমে ক্রিসেন্ট গ্রুপ চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে হংকং ও ব্যাংককে। সেই রপ্তানি বিল ক্রয় করে গ্রুপটিকে নগদ টাকা দিয়েছে ব্যাংক। রপ্তানির টাকা ফেরত আসেনি। তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সরকার থেকে নেওয়া নগদ সহায়তার টাকা দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে গ্রুপটি। ব্যাংক থেকে নেওয়া ১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মামলায় জেলও খেটেছেন ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদের। তার ভাই জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার এম এ আজিজের রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। শুধু খাজা সোলায়মান আনোয়ার, এম এ কাদের বা এম এ আজিজ নন, ইচ্ছাকৃত এমন ঋণখেলাপিদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের ঘটনা শত শত। অনেকেই ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পুরোটাই মেরে দিয়ে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইচ্ছাকৃত এই খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন ব্যাংকার ও ব্যাংকের পরিচালকরা। ব্যবসায়িক সক্ষমতার বাছবিচার না করে সামান্য লোভ বা চাপে শত শত কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিতে ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন সুবিধার জন্য ইচ্ছাকৃত খেলাপিরাই সবার আগে হাজির হচ্ছেন ব্যাংকে। কোনো ব্যবস্থা নিলে সঙ্গে সঙ্গে এই ঋণখেলাপিরা আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিচ্ছেন। ফলে অনেকটা নিরুপায় হয়ে পড়ছে ব্যাংক। টাকা আদায় হচ্ছে না। এভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কালক্ষেপণ করছেন ঋণখেলাপিরা।

ব্যাংক থেকে লোপাট করা ও ভুয়া রপ্তানির বিপরীতে নেওয়া সরকারি ভর্তুকির অর্থে বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন শাহজাহান। তিনি মাটির তৈরি টেরাকোটা টাইলস প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহের এসবি এক্সিমের মালিক। ব্যাংকের খাতায় তিনি শীর্ষ ঋণখেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় তার নাম রয়েছে অর্থ পাচারকারী হিসেবে। জানা গেছে, বিদেশে শাহজাহানের বিলাসী জীবনযাপনের পুরো অর্থই গেছে দেশ থেকে। ব্যাংক থেকে লোপাট করা প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটা অংশ এবং ভুয়া রপ্তানির বিপরীতে হাতিয়ে নেওয়া সরকারি ভর্তুকির টাকায় বিদেশে তিনি বিলাসী জীবনযাপন করছেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ পরিদর্শনে উঠে আসে, আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে মাটির তৈরি টেরাকোটা টাইলস রপ্তানি করেছে এসবি এক্সিম নামের ঝিনাইদহের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেই রপ্তানির বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা এখনো দেশে আসেনি। দুবাই ও সিঙ্গাপুরে পাঁচ ধরনের ব্যবসা রয়েছে শাহজাহানের। এর মধ্যে দুবাইয়ে রয়েছে পুণ্য জুয়েলারি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পুণ্য ফুড স্টাফ ট্রেডিং ও পুণ্য জেনারেল ট্রেডিং। আর সিঙ্গাপুরে রয়েছে পুণ্য গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড পিটিই ও পুণ্য সুপার মার্কেট পিটিই লিমিটেড।

ব্যাংকের ৩৩ কোটি টাকা মেরে আমেরিকায় পাড়ি জমান চট্টগ্রামের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মেহজাবীন আরেফিন ও তার স্বামী আমির আজম চৌধুরী। এই দম্পতি তাদের চারটি গার্মেন্টের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। পরবর্তী সময় ব্যাংকের মামলায় চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত তাদের নামে সাজার পরোয়ানা জারি করেন। ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বরের একটি ৯ তলা জরাজীর্ণ ভবন জামানত দিয়ে দুটি ব্যাংক থেকে ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ নেয় ক্লাসিক সাপ্লাইজ ও কোমো অ্যাপারেলস। ঋণ নেওয়ার পর ব্যবসা গুটিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাশেদ ও পরিচালক এ এইচ এম রায়হান শরীফ পালিয়েছেন থাইল্যান্ডে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ার জন্য ঋণখেলাপিরা ঘোষণা দিয়ে দেউলিয়া হতে চান। এদের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত খেলাপি। এর দায় শুধু ঋণখেলাপিদের নয়, ব্যাংকেরও। ব্যাংকের পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও যোগসাজশ ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়া সম্ভব নয়। এদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া বন্ধ করার জন্য সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দু-একজন ঋণখেলাপিকে শাস্তি দিয়ে বিচার বিভাগকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে অন্যরা দেখে ভয় পান। কোনো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও ওই গ্রুপেরই অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পাচ্ছে। গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের বীমা-সুবিধা বাতিল করতে হবে। বারবার শুধু তদন্ত করে প্রতিবেদনের মধ্যে আটকে থাকলে টাকা আদায় হবে না।

সর্বশেষ খবর