মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিস্ফোরণ যে কারণে

সাখাওয়াত কাওসার

মিথেন ও কার্বন মনোঅক্সাইডের উপস্থিতি মিলেছে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে সেই শিরিন ম্যানশনে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্যুয়ারেজ কিংবা গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে নির্গত গ্যাসকুণ্ডলী ছিল তৃতীয় তলার অভ্যন্তরে। একই সঙ্গে ছিল কার্বন মনোঅক্সাইডের উপস্থিতি। কার্বন মনোঅক্সাইড এসি থেকেও নির্গত হয়ে থাকতে পারে। এ দুই গ্যাসের কুণ্ডলীতে কোনো ধরনের স্পার্কিং কিংবা আগুনের সংস্পর্শেই এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা তাদের।

দীর্ঘদিন ধরেই শিরিন ম্যানশনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে বিস্ফোরণের মাত্রা এতটা তীব্র হয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ‘শিরিন ম্যানশন’ নামের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। তবে অনেক দিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও তা কেন চিহ্নিত করা হয়নি এ নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। এ ছাড়া বিস্ফোরণের পর থেকেই ভবনের মালিকানা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভবনের প্রকৃত মালিক দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে অনেকেরই নজর এ ভবনের দিকে। স্থানীয় এক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা গণমাধ্যমকর্মীদেরও এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হুমকি দিচ্ছেন। গতকাল সরেজমিনে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা এবং ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে, ভবনটির উত্তর পাশের অংশে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ’ এমন লেখা দুটি ব্যানার টাঙিয়ে রেখেছে ডিএসসিসি। ভবনের আশপাশে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। ১৪-১৫ জন পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। বিস্ফোরণের ফলে ভবনটির সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া ইট, কাচ, আসবাবপত্র যেভাবে ছিল সেভাবেই রয়েছে। এসবের সঙ্গে নিহত ও আহতদের রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেছে। ভবনটির উত্তর পাশ সংলগ্ন গলির একটি অংশ বাসিন্দাদের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

তবে বিস্ফোরণের পর থেকেই চাপা আতঙ্কে ভুগছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। কোনো ধরনের অনুমান ছাড়াই এমন বিস্ফোরণের স্মৃতি ভুলতে পারছেন না অনেকে। আবার শিরিন ম্যানশনের বিস্ফোরণ নিয়ে অনেকেই নানা মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ বলছেন, ভবনটির দিকে অনেকেরই চোখ ছিল দীর্ঘদিন ধরে। প্রকৃত মালিক শিরিন আক্তার দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে থাকায় অনেকেরই নানা পরিকল্পনা ছিল ভবনটি ঘিরে। যদিও এ বিষয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া বেস্ট টেইলরের মালিক এ প্রতিবেদককে বলেন, এক সপ্তাহ আগে শিরিন আক্তারের ভাই লোকজন দিয়ে ভবনের জমির পরিমাণ মাপিয়েছেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। রবিবারের বিস্ফোরণে তার দোকানের আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে এবং দোকানে থাকা শার্ট-প্যান্টের সব কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল সকালে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের দ্বিতীয় ও নিচতলার দোকানিরা এসে দোকান খুলতে না পেরে সেখানে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। বিস্ফোরণে তিনজন নিহতসহ অর্ধশতাধিক আহতের ঘটনা ঘটলেও দুই দিনেও খোঁজ মেলেনি ভবন কর্তৃপক্ষের। পুলিশও চেষ্টা করে ভবন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাশেম লিটন নামের এক ব্যক্তি ভবনটির সবকিছু তদারক করছেন। অনেক গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গেও তিনি অসদাচরণ করেছেন। এ ভবন নিয়ে এত মাতামাতি না করতেও বলেন তিনি। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আবুল হাশেম লিটনের। তিনি বলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি তিনি। এ ছাড়া তিনি ফ্ল্যাট ও ভবন মালিক সমিতির সেক্রেটারি। এ জন্যই প্রতিবেশী হিসেবে বিষয়টি তার আওতার মধ্যেই পড়ে বলে দাবি করেন তিনি।

বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির পূর্ব পাশের আবাসিক ভবন ‘সুরাইয়াস ড্রিম’ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনটির অনেকগুলো জানালার কাচ ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের তৃতীয় তলা বরাবর সুরাইয়াস ড্রিমের তৃতীয় তলার দেয়াল ভেঙে গেছে। এতে ওই ভবনের দুজন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মাহবুবুল নবী (৬০) নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ বিষয়ে সুরাইয়াস ড্রিমের তৃতীয় তলার বাসিন্দা আহত মাহবুবুল নবীর ছেলে শাহরিয়ার জানান, তার বাবা চেয়ারে বসে ছিলেন। বিকট শব্দে শিরিন ভবন বিস্ফোরণে তাদের দেয়াল ভেঙে তার বাবার গায়ের ওপর পড়ে। এতে তার ডান হাতের চামড়া ছিলে গেছে, পা ভেঙে গেছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে গেছে।

নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল গণি সাবু বলেন, ‘ভবনটির মালিক শিরিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। তারা তিন বোন দুই ভাই। তবে তাদের পরিবারের কেউ এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমরা মৃতদেহগুলো তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। সবকিছুই আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদারক করছেন।’ এদিকে বিস্ফোরণের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নাশকতার আলামত মেলেনি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে এ দুর্ঘটনা।’ ডিজি বলেন, ‘দুর্ঘটনা, নাকি অন্য কারণে সায়েন্স ল্যাবের ঘটনা তা জানতে আমি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছিলাম। তারা একটি টিম পাঠিয়েছিলেন। তারা সেখানে কাজ করেছেন। তাদের বোম ডিসপোজাল টিম জানিয়েছে, সেখানে নাশকতা বা বিস্ফোরকজাতীয় কিছু থেকে বিস্ফোরণের আলামত পাওয়া যায়নি।’ এদিকে বিস্ফোরণের তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তদন্তের অগ্রগতি হলো, জমে থাকা গ্যাসের সঙ্গে স্পার্কিং কিংবা কোনোভাবে আগুনের সংস্পর্শেই এ বিস্ফোরণ হয়েছে। আরও কিছু বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি। স্যুয়ারেজ ছাড়া অন্য কোনোভাবে মিথেন কীভাবে এলো তা-ই আমরা খুঁজে দেখছি।’

লাশ হস্তান্তর আহতদের জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন : বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত তিনজনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। পরে পুলিশ গতকাল নিহতদের পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশগুলো বুঝিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এবং ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ১০ জনের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক।

বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বার্ন ইনস্টিটিউটে মোট পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়। গতকাল সকালে ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতাল থেকে আরও একজনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। তার নাম স্বপ্না রানী সাহা (৩৯)। তার শরীরের ১৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। বর্তমানে ছয়জন এখানে ভর্তি রয়েছেন। আশরাফুজ্জামান ও হাফিজুর রহমানের শরীরে যথাক্রমে ৬ ও ৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। আশা, জহুর আলী ও আকবরের শরীরের যথাক্রমে ৩৮, ৪৪ ও ৩৭ শতাংশ দগ্ধ। তবে আমরা কাউকে শঙ্কামুক্ত বলতে পারছি না।’

ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা : ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত ডিএসসিসির আঞ্চলিক কমিটির সিদ্ধান্তে শিরিন ম্যানশনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ইতোমধ্যে সেখানে ব্যানার টানানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংক্রান্ত ডিএসসিসির টেকনিক্যাল কমিটিকে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে আঞ্চলিক কমিটি। টেকনিক্যাল কমিটি এ ভবন নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর