বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোটের আগে যত কূটনৈতিক তৎপরতা

ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাক্ষাৎ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে, ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক বিএনপির, বিদেশেও দুই দল বাড়িয়েছে যোগাযোগ

জুলকার নাইন

ভোটের আগে যত কূটনৈতিক তৎপরতা

নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই শুরু হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। নির্বাচন নিয়ে দেশের ভিতরে-বাইরে আগ্রহ থেকেই চোখে পড়ার মতো কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রকাশ্যে ও আড়ালে বৈঠক চলছে হরহামেশা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দল শামিল হয়েছে এই কূটনৈতিক মিশনে। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ। আসছে নির্বাচন নিয়ে বৈশ্বিক এই আগ্রহ বড় দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের মেরুকরণও তৈরি করছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। জানা যায়, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সর্বশেষ গতকাল দুপুরে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের আমন্ত্রণে তার বাসভবনে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে নেতারা এতে অংশ নেন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মি আহমেদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ এ আরাফাত। দুই পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাউন্সিলর স্কট ব্রেন্ডন, রাজনৈতিক শাখাপ্রধান আরতুরো হাইনস, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির সুশাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক টিম লিডার মেধাউই গিরি এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা মেথিউ বেহ।

বৈঠক প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস টুইটার বার্তায় বলেছেন, সাক্ষাতে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং বাণিজ্য, জনগণের মধ্যে সম্পর্ক, নিরাপত্তা সহযোগিতা পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ ভাগাভাগি করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজের পরিধি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার এক দিন পরই আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠক হলো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের। বৈঠক সূত্র জানায়, এতে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন দেশটির কূটনীতিকরা।

বিপরীত দিকে, গত বৃহস্পতিবার বিএনপির নেতাদের ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে। দীর্ঘ সময় ধরে বিএনপির সঙ্গে ভারতের কথিত বৈরিতার পর এই খোলামেলা আলোচনা আগ্রহের জন্ম দিয়েছে সব মহলেই। বৃহস্পতিবারের ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার বাসভবনে ওই নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপির পাঁচ নেতা। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে নৈশভোজে যাওয়া অন্য নেতারা হলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম।

ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে এই বৈঠক নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ থেকেই বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া না হলেও সূত্রের খবর, এ বৈঠকে তাদের মধ্যে আগামী নির্বাচন, আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। গুরুত্ব পায় ভারত ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও। নৈশভোজে মূলত আগামী নির্বাচন ও আন্দোলন সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান জানতে চান ভারতীয় হাইকমিশনার। নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি না জানতে চাইলে দলটির নেতারা সাফ জানিয়ে দেন- দলীয় সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না। যত দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হবে, তত দিন শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিএনপি বলেও জানানো হয়। এ ছাড়া খোলামেলা আলোচনায় ভারতের সঙ্গে বিএনপির দলীয় সম্পর্কের উত্থান-পতন নিয়েও আলোচনা হয়েছে নৈশভোজে।

এ ছাড়া ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও পাল্টাপাল্টি বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে। কূটনৈতিক সূত্র জানান, তারা আগামী নির্বাচন নিয়ে অবস্থান তৈরির জন্যই করেছে এ বৈঠক। কারণ সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি ইইউ। ওই সময় আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠাবে না ইইউ। এবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘোষণা এসেছে ইতোমধ্যে।

১২ মার্চ সকালে ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির গুলশানের বাসভবনে বৈঠক করেন বিএনপির নেতারা। ইইউভুক্ত সাত দেশের কূটনীতিক ও বাংলাদেশ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক সদস্য শ্যামা ওবায়েদ। দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির নেতৃত্বে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ডেনমার্ক, নরওয়ের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তারা সাফ জানিয়ে দেন, বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না।

এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ইইউ কূটনীতিকরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের একটি প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইইউর বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে বাজেটও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইইউ থেকে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়।

আগের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। সেখানেও আসে আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গ। গণভবনে অনুষ্ঠিত সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। ইসি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। ইসির অধীনেই হবে নির্বাচন। একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের সরকারি বার্তা সংস্থা জানায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ সমর্থনের কথা জানিয়েছে ভারত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বেড়ে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকসহ প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে বড় দলগুলোর যোগাযোগ। কখনো কখনো তাদের উৎসাহী অবস্থান কূটনীতিকদের নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। সাম্প্রতিক সময়েও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। এবারের বিশেষত্ব বড় কূটনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে মেরুকরণ। কারণ ইতোমধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে চাপ সৃৃষ্টির চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আবার পশ্চিমা দেশগুলোর বিপরীতে থাকা চীনের রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে কারও অধিকার নেই বলে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। আর পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায় রাশিয়ার পশ্চিমাবিরোধী ভূমিকা এখন চরম বাস্তবতা। আগামী  ডিসেম্বরে ভোট ঘনিয়ে এলেই এসব আরও প্রকাশ্য হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সরকারদলীয় কূটনৈতিক দায়িত্বে থাকা একাধিক শীর্ষস্থানীয় সূত্র জানায়, বিশ্বের কাছে বার্তা দেওয়া হচ্ছে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাইছেন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। কূটনীতিকরাও চাইছেন একটা সুন্দর নির্বাচন। আওয়ামী লীগ তাদের সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আসন্ন নির্বাচন যে এ সরকারের অধীনেই হবে এবং তৃতীয় মাধ্যমের কোনো প্রয়োজন নেই, সে কথাও স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা দূতাবাসের কূটনীতিকদের এ বিষয়ে সজাগ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সূত্রগুলো। অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের পরিস্থিতি, সরকারের বিভিন্ন ‘নেতিবাচক কর্মকান্ড’ ও দলের অবস্থান তুলে ধরতে দেশে-বিদেশে নানাভাবে বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে। জানা যায়, গত দুই মাসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে বেশ কয়েকজন নেতা প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ সফরও করেছেন। আসছে দিনগুলোতে তাদের এ ধরনের সফর ও বৈঠক বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা।

 

সর্বশেষ খবর