বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
বঙ্গবাজারে আগুন

দ্বিতীয় দিনেও আগুন ধোঁয়া

♦ কারণ উদঘাটনের চেষ্টা ♦ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বিতীয় দিনেও আগুন ধোঁয়া

রাজধানীর বঙ্গবাজারের পাশে এনেক্সকো টাওয়ারে গতকালও আগুন এবং ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে বলার ৩০ ঘণ্টা পরও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। আগুনের কারণ উদঘাটনে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তারা বঙ্গবাজারসহ আশপাশ এলাকার বিভিন্ন ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছেন। আগুনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে বিশেষ সহায়তা কামনা করেছেন। ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছিলেন, একটি মহল দীর্ঘদিন ধরেই এটা চেয়ে আসছিল। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কিংবা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত কমিটি। গতকাল সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আগুন এখনো থেমে থেমে জ্বলছে। লাইফ সেভিং ফোর্সের সদস্যরা পানি দিয়ে তা নেভানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গতকালও বঙ্গবাজার এলাকা ঘিরে ছিলেন শত শত ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী। এর মধ্যে কেউ হাতড়িয়ে দেখছিলেন, ক্যাশবাক্সের টাকা, কাপড়সহ তাদের সরঞ্জাম। তারা অক্ষত কিছুই পাননি, ধ্বংসস্তূপে পেয়েছেন কিছু পুড়ে যাওয়া সরঞ্জাম। গতকাল বিকালে ঘটনাস্থলে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

দিনভরই ব্যবসায়ী সমিতি থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের তালিকা করা হয়। লাইন ধরে শত শত ব্যবসায়ীকে নাম লেখাতে দেখা যায়। এ সময় পুরে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া কিছু সেলাই মেশিন নিয়ে ঝগড়াঝাটি হতেও দেখা গেছে। পুরো এলাকার নিরাপত্তার দেখভাল করছিল পুলিশ। গতকাল বিকালে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানায় কোনো মামলা হয়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা শাহবাগ থানায় জিডি করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আগুনের প্রকৃত সোর্স যেটি, তা আমরা এখনো খুঁজে বের করতে পারিনি। মালামাল বের করে আনার কারণে এখনো কোথাও কোথাও একটু একটু আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া হচ্ছে। আগুন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করতে পারিনি। স্পটে এখনো ফায়ার সার্ভিসের ১২ ইউনিট কাজ করছে। পানির স্বল্পতা রয়েছে। পর্যাপ্ত পানি কাছাকাছি না পাওয়ার কারণেও আগুন নির্বাপণ করতে দেরি হচ্ছে। তবে আমরা আশা করি আজকের মধ্যে আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করতে পারব।’ ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ফের ব্যবহারের উপযোগী আছে কি না জানতে চাইলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এনেক্সকো টাওয়ারের বিভিন্ন পিলারে ফাটল ধরেছে। এখন রাজউক এবং তাদের ইঞ্জিনিয়াররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। তাদের অনুমতি ছাড়া পুনরায় ভবনে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আগুনের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একটি, আর আরেকটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়েছে।

বিমা নিয়ে ভাবছেন ব্যবসায়ীরা : ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০ বছর আগে সিটি করপোরেশন থেকে ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে বঙ্গবাজার মালিক সমিতির আন্ডারে এই মার্কেটটি তৈরি করা হয়। মালিকরা দোকানভেদে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসে ভাড়া নেয়। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে হিরু গাজী নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের কোনো বিমা নেই। ভবিষ্যতে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করব।

এখনো মামলা হয়নি : ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বলেন, কোনো মামলা হয়নি। তবে মামলা হবে বলে শুনেছি। অভিযোগ নিয়ে আসলে মামলা হবে। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, আমরা আমাদের মতো করে বিভিন্ন ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছি। এগুলো পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন : গতকাল বিকাল ৩টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সব সময় মনিটর করছেন এবং কী করা যায় তার সিদ্ধান্ত তিনি দেবেন।

ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা হবে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটার সিদ্ধান্ত হবে। এটা সিটি করপোরেশন টেন্ডারও করেছিল। একজন কন্ট্রাক্টও করেছিল। তারপর ব্যবসায়ীদের আবেদনে হাই কোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। এখানে আধুনিক ও নিরাপদ মার্কেট হতে পারে, সেই ব্যবস্থা নেবে সিটি করপোরেশন।

তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিস যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে কিংবা করবে, সেগুলো যেন ব্যবসায়ীরা পরিত্যাগ করেন। রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজারে আগেও ১০ বার নোটিস দেওয়া হয়েছিল। পানি সংকটের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসকে আমরা ঢেলে সাজাচ্ছি। পানির সরবরাহ না থাকলে ফায়ার সার্ভিস অসহায় হয়ে পড়ে। পানির ব্যবস্থা থাকার জন্য সিটি করপোরেশন ও রাজউক ব্যবস্থা নেবে।

যা বললেন ফায়ার ডিজি : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে চার বছর আগেই অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। তখন ফায়ার সার্ভিস থেকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে বেশ কিছু ব্যানারও টাঙানো হয়েছিল। সবাই জানত এই কমপ্লেক্স বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু এরপর সরকারের অন্য কোনো সংস্থা কিংবা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিকেরা অগ্নিঝুঁকি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। আমরা আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে রাজধানীর হালনাগাদ ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা করা শুরু করব। তিনি আরও বলেন, গত দুই দিন মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ৭০০ সদস্য আগুন নেভানোর কাজ করেছেন। এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি হচ্ছে বলে শুনেছি। সেখানেও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি থাকবে। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। আপনারা তাদের আহাজারি দেখেছেন। আমরাও এ ঘটনায় ব্যথিত। আমরা দুর্ঘটনা-দুর্যোগে সবার আগে সবার পাশে থাকি। কোনো দুর্ঘটনা কাম্য নয়। উল্লেখ্য, বঙ্গবাজার মার্কেটে এর আগেও কমপক্ষে তিনবার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে ১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুরো বিপণিবিতান পুড়ে যায়। এ ছাড়া ২০১৮ সালেও একবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

সর্বশেষ খবর