এক দিন আগেও যে স্থানটি রঙিন কাপড় মোড়ানো ছিল স্বচ্ছ পলিব্যাগে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে ছিল জমজমাট। ছিল নিত্যসঙ্গী যানজটও। এখন সেখানে ধ্বংসস্তূপ আর হাহাকার। বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর যেন এখানকার ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ থামছেই না। গতকাল আগুনে পোড়া স্তূপে চাপা পড়া অন্য ব্যবসায়ীদের মতো নিজের স্মৃতি খোঁজার চেষ্টা করছিলেন আবু তাহের। তার দোকানটি কোথায় ছিল, কোথায় ছিল তার কর্মব্যস্ততা, তার ক্যাশ বাক্সটি আছে কি না- এসব। কিন্তু হাজারো পুড়ে যাওয়া দোকানের মাঝে তারটি তিনি কোথাও পাচ্ছিলেন না। যেন আধপোড়া কাপড়ে ঢেকে গেছে তার সব স্মৃতি। আবু তাহের বলছিলেন, এই মহাবিপদে তিনি কাঁদতে ভুলে গেছেন। কোনো ধরনের সহযোগিতা না পেলে তিনি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না জানেন না। তার ভাষ্য, ‘একটি দোকান নিতে অগ্রিম দিতে হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ভাড়াও লাগে বেশি। মালামালও অনেক টাকার ছিল।’ এসব যখন তিনি বলছিলেন তখন তার গলা ভারী হয়ে আসছিল, আর চোখ থেকে পানি ঝরছিল। ইমরান নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, শুধু তিনি নন, তাদের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের এখানে বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে তারা দোকানে নতুন মালামাল তুলেছিলেন। এ জন্য কেউ কেউ ধারদেনাও করেছেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে ঈদকেন্দ্রিক তাদের এ স্বপ্ন। তার শ্বশুর আগুন লাগার খবর পেয়ে স্ট্রোক করেছেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বঙ্গবাজারের যে স্থানটিতে হকার্স মার্কেট ছিল সেখানে পোড়া টিনের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন ব্যবসায়ী জসিম। পরিচিত যাকে পাচ্ছিলেন, তাকেই জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে বলছিলেন- ‘সব শেষ, আমিও পুইড়া শেষ।’ এ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে আরও অনেক ব্যবসায়ীর স্বপ্ন। আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এখানে পাইকারি কেনাবেচার জন্য মজুদ করা হয়েছিল পোশাক। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় লাগা আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় মানুষের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে গতকাল বিকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী নেতারা। নেতাদের মধ্যে ছিলেন আফজাল হোসেন এমপি, আবদুর রহমান, হুমায়ুন কবির, জহুরুল ইসলাম ও লোকমান খান। বৈঠক শেষে বঙ্গবাজার মহানগর শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, মেয়রের কাছে আমরা আমাদের সব অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছি। উনি শুনেছেন। আমাদের এই স্থানে পুনর্বাসন করে দেবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমাদের একটা অনুদানের ব্যবস্থা করে দেবেন। এ জন্য আমাদের ব্যবসায়ীদের একটা তালিকা চেয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সহায় সম্বল হারানো, পথে বসা ব্যবসায়ীরা সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে মানববন্ধন করেছেন। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির ব্যানারে এই মানববন্ধন করা হয়। গতকাল বেলা পৌনে ১১টায় ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে করা মানববন্ধনে ব্যবসায়ীরা বলেন, ঈদের আগে প্রতিটা মার্কেট মালামাল দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। আগুনে তাদের সব পুড়ে শেষ। এখন সরকার যদি তাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে তাদের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যাবে। এ জন্য তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা কামনা করেন। এনেক্সকো টাওয়ারের পাশেই অস্থায়ী চায়ের দোকানদার সাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা লেগে থাকত। কিন্তু আজ সব পুড়ে গেছে, কিছুই নেই, নেওয়ার মতো আর কিছুই নেই। ক্রেতা-বিক্রেতার কারও ব্যস্ততা নেই। আগুন সব শেষ করে দিয়েছে। ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া কিছুই নেই, ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেছেন আজ।