শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
ঝুঁকিতে মার্কেট-শপিং মল

দায়সারা নোটিসেই সময় পার

তিন বছরে ১৪৭৫টি অগ্নিকান্ড

সাখাওয়াত কাওসার

দায়সারা নোটিসেই সময় পার

দায়সারা নোটিসেই সময় পার করছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। জরিপের পর ভবনের গায়ে কেবল অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ব্যানার সাঁটিয়েই দায় সারছে সংস্থাটি। তবে চিঠি ইস্যুর পরে আর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ঘটেই চলেছে একের পর এক ভয়ংকর অগ্নিকা-। ফায়ার সার্ভিসের ২০১৮ সালের জরিপে রাজধানীতে ১ হাজার ৩০৫টি ‘অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ’ বাণিজ্যিক ভবনের মধ্যে ১৫টি ছিল ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’। এ ১৫টির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স’। টানা ১০ বার নোটিস ইস্যুর পরও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনেনি মার্কেট কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়ংকর অগ্নিকা- রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর বিপণিবিতানের অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে সংশ্লিষ্টদের। ফায়ার সার্ভিসের জরিপই বলছে, প্রতি বছরই বাড়ছে বিপণিবিতানে আগুনের ঘটনা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স (অগ্নিনির্বাপণ) অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইনউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইন আমাদের যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, ততটুকুই আমরা প্রয়োগ করছি। আইনের বাইরে তো আমরা যেতে পারি না। তবে আমাদের সব সদস্য প্রতিটি ঘটনায় তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে আসছেন। এখন আমরা জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর মার্কেটগুলোয় যাচ্ছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ দিয়েই অগ্নিনির্বাপণের একমাত্র বিশেষায়িত সংস্থা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরকে নখদন্তহীন বাঘ বানিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে কেবলই চিঠি ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাদের। সে আইনে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সিলগালা করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ১৯৯৫ সালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে প্রথমবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেহতাব উদ্দীনকে প্রধান করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে ছিলেন রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধি। প্রতি মাসের মঙ্গলবার অগ্নিনির্বাপণ অধিদফতরেই তারা মিটিংয়ে বসতেন। ওই কমিটির তত্ত্বাবধানেই সপ্তাহের প্রতি শনিবার ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান, গার্মেন্টস কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিসে মহড়া দিতেন। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফায়ার সেফটি লাইসেন্স ছাড়া কোনো কারখানা, মার্কেট কিংবা বহুতল ভবনের অনুমোদন ছাড়পত্র দেওয়া হতো না। ভবন নির্মাণ আইন ও ফায়ার সেফটি লাইসেন্সকে খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হতো। তবে ২০০৩ সালের পর থেকে রহস্যজনক কারণে ওই কমিটির কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। উচ্চ পর্যারের সেই কমিটির বিষয়টি নিশ্চিত করেন তৎকালীন সহকারী পরিচালক, পরে উপপরিচালক হিসেবে অবসরে যাওয়া মতিউর রহমান।

এদিকে অগ্নিনির্বাপণ বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপপরিচালক সেলিম নেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ব্যানার টানানো এবং চিঠি ইস্যুর পরও যদি ওই ভবন মালিক ব্যবস্থা না নেন, তাহলে অগ্নিনির্বাপণ অধিদফতর মামলা করবে। তখন আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিস একা কোনো কিছু পারে না। আইনেই তাকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি কাজে ইউটিলিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠান- ওয়াসা, তিতাস, ডেসকো, সিটি করপোরেশন, রাজউক সরাসরি জড়িত।

তিন বছরে হাজার ৪৭৫ অগ্নিকান্ড : গত তিন বছরে রাজধানীসহ সারা দেশের শপিং মল ও মার্কেটে ১ হাজার ৪৭৫টি অগ্নিকান্ড ঘটেছে। এর মধ্যে কেবল গত বছরেই ঘটেছে ৫৮৯টি অগ্নিকান্ড। ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, আগুনে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ৯৭ লাখ ১২ হাজার ৫৫৫ টাকা।

সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে রাজধানীসহ সারা দেশে ৫৮৯টি মার্কেট ও শপিং মলে অগ্নিকান্ড ঘটে। তাতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ৯৭ লাখ ১২ হাজার ৫৫৫ টাকা। এর আগের বছর ২০২১ সালে মার্কেট ও শপিং মলে অগ্নিকান্ড ছিল ৪৫৮টি। ক্ষতির পরিমাণ ৯ কোটি ৬৪ লাখ ১২ হাজার ৪০০ টাকা। ২০২০ সালে মার্কেট ও শপিং মলে অগ্নিকান্ড ছিল ৪২৮টি। ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি ১০ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৭ টাকা।

চার বছরেও পরিবর্তন নেইঅগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের : গত চার বছরেও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসেনি ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩৯টি ভবনের। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জরিপের পর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সেই তালিকায় থাকা ভবনগুলো নামকাওয়াস্তে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র সংযোজনের দোহাই দিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। তারা বছরের পর বছর ধরে ভবনগুলোয় তাদের বাণিজ্যিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বুধবার রাজধানীর মগবাজারের রাজ্জাক শপিং সেন্টারে গিয়ে জানা যায়, অনেকটা আগের অবস্থানেই রয়েছে তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও তা স্বীকার করেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে। যদিও সেই ভবনের ম্যানেজার মেহেদী হাসান দাবি করেছেন, তারা অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি সংযোজন করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবাজারের চারটি ইউনিটকে ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ চিহ্নিত করে বাজার কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয় ফায়ার সার্ভিস। একই বছরের মে মাসে বঙ্গবাজারের ত্রুটিগুলো তুলে ধরে মার্কেট কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিস দেওয়া হয়, যাতে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। যদিও নোটিসের আট মাস পর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিট পুনরায় পরিদর্শন করে মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনরায় ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ বলা হয়। এরপর ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০০৬ এবং অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ মোতাবেক বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিটে অগ্নিপ্রতিরোধ, নির্বাপণব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য মার্কেট কর্তৃপক্ষকে পুনরায় নোটিস ও নির্দেশ দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সর্বশেষ বুধবার লাইফ সেভিং ফোর্স এবং এনএসআই রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা তদারকিতে যায়। অভিযানে থাকা একাধিক সদস্য এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে নোটিস দেওয়ার পরও সেই মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর