বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
বঙ্গবাজার নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন

নাশকতার প্রমাণ মেলেনি প্রহরীর সিগারেট থেকে আগুনের সূত্রপাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর বঙ্গবাজারের আদর্শ ইউনিটের চতুর্থ তলায় থাকতেন আটজন নিরাপত্তা প্রহরী। প্রহরীদের একজন হোসেন পাটোয়ারীর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। হোসেন পাটোয়ারী প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করলেও অন্য প্রহরীদের থেকে জানা যায়, ধূমপানের অভ্যাসের জন্য এক বছর আগেও মার্কেট কমিটি তাকে সতর্ক করেছিল। এতে প্রমাণ হয়, হোসেন তার সাক্ষ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। ঘটনার দিন রাতে সাহরি খাওয়ার পর লুকিয়ে সিগারেট পান করতে পারেন। এরপর সিগারেটের আগুন পা দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেন, আর সেই আগুন কাঠের তক্তার ফাঁকা অংশ দিয়ে সরাসরি তৃতীয় তলায় পড়ে। এতে আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, আগুন লেগেছিল নিরাপত্তা প্রহরীদের থাকা জায়গা বরাবর তৃতীয় তলার আলমগীর এমব্রয়ডারি থেকে। বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের কারণ অনুসন্ধানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে এমনটি উল্লেখ করেছেন। গতকাল বিকালে কমিটির সভাপতি ও অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে নিরাপত্তা প্রহরীদের ব্যবহার করা মশার কয়েল থেকে হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে সিগারেটের আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাতকে সর্বাধিক যুক্তি হিসেবে দেখছে তদন্ত দল। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত নয় এবং ঘটনাটি নাশকতা নয় বলেও মনে করছে তদন্ত দল।

আগুনে ভস্মীভূত চার মার্কেটের ২ হাজার ৯৬১ জনসহ আশপাশের কয়েকটি মার্কেট মিলিয়ে মোট ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার। আর মার্কেটের মালামালের ক্ষতির পরিমাণ ২৮৮ কোটি ৩৫০ লাখ টাকা। জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি ও অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন বলেন, আমরা তদন্ত শেষে মেয়রের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে যা যা পেয়েছি সবই উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ১০টি সুপারিশও করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা তদন্তে ডিএসসিসি আট সদস্যের তদন্ত কমিটি আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানের জন্য মার্কেটের ছয়জন নিরাপত্তা প্রহরী ও একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রির সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সাক্ষ্য গ্রহণে তদন্ত দল জানতে পারে, আদর্শ ইউনিটের নিরাপত্তা প্রহরী বিল্লাল হোসেন ৫টা ৪০ মিনিটে মার্কেট ও দোকানের লক সিস্টেম পরীক্ষা করতে গেলে চতুর্থ তলার নিরাপত্তা প্রহরীদের ঠিক নিচের তৃতীয় তলার আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্সের ১১৮ নম্বর দোকান তালা বন্ধ শাটারের নিচ থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখেন। দোকানটি সরাসরি নিরাপত্তা প্রহরীদের রুমের নিচে অবস্থিত। প্রহরীদের রুমের মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি, যাতে মাঝে মাঝে ফাঁকা বা গ্যাপ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেঝের ফাঁকা দিয়ে সিগারেটের আগুন নিচে আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্সে পড়ে আগুন ধরে যেতে পারে। প্রতিবেদনে অগ্নিকা-টি নাশকতামূলক কি না, সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, দুর্ঘটনার রাতে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটের সব মেইনগেট বন্ধ ছিল এবং নিরাপত্তা প্রহরীরা দায়িত্বরত অবস্থায় ছিলেন। যেই মার্কেট ও টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত সেটি বেশ ভিতরে উত্তর-পূর্ব দিকে এবং পুলিশ সদর দফতরের নিকটবর্তী স্থানে। এটি প্রহরীদের থাকার কক্ষের সরাসরি নিচে অবস্থিত। নাশকতার উদ্দেশে কেউ এরকম একটি জায়গায় আগুন লাগানোর পরিকল্পনা করা অযৌক্তিক। নাশকতার উদ্দেশ্য থাকলে মার্কেটের বাইরের দিকে মেইন রাস্তার পাশে অবস্থিত কোনো দোকানকেই টার্গেট করার কথা বা পাশর্বর্তী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে কোনো মাধ্যমে কিছু ছুড়ে দিলেও যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম। যেই টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে সেখান থেকে মার্কেটের বৈদ্যুতিক ডিস্ট্রিবিউশন বক্স আনুমানিক ৫০ গজ দূরে অবস্থিত। যদি শর্টসার্কিটের মাধ্যমেই আগুন লাগত তাহলে ডিস্ট্রিবিউশন বক্সের আশপাশের দোকানে আগুন লাগার সম্ভাবনা ছিল। নিরাপত্তা প্রহরীরা গেলে তখনো করিডরের লাইটগুলো জ্বলতে দেখেন। শর্টসার্কিট হলে বাতিগুলো নিভে যেত। এ ছাড়া মার্কেটের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কাটআউট প্রদ্ধতিতে ছিল, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগলে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ হয়ে যেত। আগুনে ভস্মীভূত চার মার্কেটের ২ হাজার ৯৬১ জনসহ আশপাশের আরও কয়েকটি মার্কেট মিলিয়ে মোট ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার। আর মার্কেটের মালামালের ক্ষতির পরিমাণ ২৮৮ কোটি ৩৫০ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিএসসিসির কোনো এলাকাতে কাঠের/টিনের মার্কেট থাকা সমীচীন নয়। যদি থেকে থাকে তা দ্রুত কং?িট বা পাকা করার ব্যবস্থা করা, মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া, এর জন্য কর্মরত কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা, নিয়মিত পরিদর্শন, মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকার ব্যবস্থা এবং এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা এবং মানসম্মত তার ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

সর্বশেষ খবর