সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই : শাহাবুদ্দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই : শাহাবুদ্দিন

নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন বলেছেন, সবাই মুখে মুখে বলছেন সামনের নির্বাচন অনেক ক্রুশিয়াল।

আমি মনে করি কোনো কিছুই ক্রুশিয়াল নয়। আমাদের সংবিধান আছে, নির্বাচন নিয়ে কারও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার যা কিছু করার আমি তা করব। গতকাল দুপুরে গুলশানে তাঁর লেখা ‘এগিয়ে যাও বাংলাদেশ’ বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা প্রয়োগ করে সংবিধানের আলোকে একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হবে। সেখানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার যেটুকু দায়িত্ব এই নিরপেক্ষতাকে বজায় রাখার জন্য, সমস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য জন্য যতটুকু প্রয়োজন করব।  মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, সাহস না থাকলে রাজনীতি করা যায় না। রাজনীতি করতে হলে দৃঢ়চেতা হতে হয়। আমি যখন দুদকে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করি, তখন সরকারের ভিতরে ছায়া সরকার ছিল। একজন সিনিয়র মন্ত্রী, তিনি প্রয়াত। আমি তাকে দেশপ্রেমিক বলি, ভাষাসৈনিক বলি। তিনি এবং আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যা বলবে, তাই করতে হবে। আমি বললাম, হোয়াই? ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কি আমাদের ফাদার-মাদার? আমার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে আসুক। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যা বলবে, আমি তা করতে পারব না। আমরা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। আপনারা পারলে করে নেন। আমার একার দৃঢ়তার কারণে বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা পূরণ করতে দিইনি।

বই হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি স্বাগত বক্তব্য দেন। গবেষক অধ্যাপক ড. এম আবদুল আলীম তাঁর বইয়ের ওপর আলোচনা করেন। বই প্রকাশের অনুভূতি ব্যক্ত করে প্রায় ৪০ মিনিট বক্তৃতা করেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন। ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক জীবন, সংগ্রাম, আইন পেশা, দুদকের চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনসহ নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণা করেন নতুন রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চুপ্পুর লেখা ২১টি কলাম ও স্মৃতিচারণামূলক লেখা, তিনটি সাক্ষাৎকার এবং তাঁর জীবন সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর দু®প্রাপ্য, ঐতিহাসিক কিছু আলোকচিত্র বইটিতে যুক্ত করা হয়েছে।

মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাকে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। অনেকে চমক বলছেন। আমিও চমক বলি। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল-নেত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাকে নির্বাচিত করেছেন। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি কী ছিলাম, কেমন ছিলাম তা এই বইটা পড়লে সবকিছুই জানতে পারবেন। তিনি বলেন, আমি দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলাম। না হলে পায়ে ডান্ডাবেড়ি দেয় কেমনে? দুর্দান্ত না হলে, সাহস না থাকলে রাজনীতি করা যায় না। সাহসিকতার সঙ্গে পদ্মা সেতু ফেস করেছি আমি একা। কী অবস্থা তখন হয়েছে? একটা পত্রিকা আমাদের সপক্ষে লেখে না। সব ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পক্ষে লেখে। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেউ কানে হাত দেয়নি। আমার দুজন কমিশনার, একজন চেয়ারম্যান সাহেব হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলেন। কথা বলতে হয় আমাকে। আমি বিচার বিভাগ থেকে এসেছি, ড. কামাল হোসেনের আইন দ্বারা আমাকে পরাস্ত করা যাবে না। ড. কামাল হোসেন আর বন্ধু রশিদের আইন দ্বারা কি পরাস্ত করা যাবে। ওনারা ছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টিমের উপদেষ্টা। ওনারা জানেন কোম্পানি আইন, শ্রম আইন। ওনারা কি পেনাল কোর্ট জানেন? সিআরপিসি জানেন? পেনাল কোর্ট, সিআরপিসি যারা জানেন, তারাই মাত্র বুঝতে পারবে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে কি না? সে কারণেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি যখন দুদকের কমিশনার ছিলাম, আমি সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, সরকারের ভিতরে ছায়া সরকার আপনার বিরোধিতা করেছে। তারপরও আপনি জিতেছেন। কারণ, আপনি বলেছেন, পদ্মা সেতু করব। আমি দেড় বছর আগে রিপোর্ট দিয়েছি, কোনো কিছু নেই। তখন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, এখনই কেন দুদক রিপোর্ট দিয়ে দিল? হোয়াই? আমরা তো স্বাধীন দেশ, স্বাধীন সংস্থা। বলতে কোনো সমস্যা আছে? আমরা দেড় বছর ধরে তদন্ত করে পেলাম, কিছুই নেই। রিপোর্ট দিয়েছিলাম। তখন একজন রিপোর্টার বললেন, তাহলে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল? আমি বলেছিলাম, অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। আমরা যা বলেছিলাম, কানাডার কোর্ট অব জাস্টিস দেড় বছর পরই একই কথা বলেছেন। তারাও বলেছেন, চায়ের কাপের ঝড় তোলার মতো। যে কারণে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো আমার কার্টুন ছেপেছে। আমার ব্যঙ্গাত্মক ছবি দিয়ে লিখেছে দুদক। আমি সত্যের পথে আছি। আমরা যা দেড় বছর আগে দিয়েছিলাম, কানাডার কোর্ট সে রকমই রিপোর্ট দিয়েছিল দেড় বছর পর।

‘এগিয়ে যাও বাংলাদেশ’ বইয়ের লেখক শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, এই বইটা আমি কেন রাষ্ট্রপতি হলাম, সেটা পরিষ্কার হবে। তখন সবাই বলবে, প্রধানমন্ত্রীর চয়েস রাইট ছিল। ড. মসিউর রহমান হয়নি, অমুক হয়নি, তমুক হয়নি, শাহাবুদ্দিন চুপ্পু হয়েছে, ঠিক যথার্থ মানুষই হয়েছে। যদিও আমি নিজেকে যথার্থ মনে করি না। কিন্তু যিনি বাছাই করেছেন, তাঁর চয়েসকে যথাযথই মনে করি। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা, আলোর দিশারি। বাংলাদেশ আজকে গর্বে গর্বিত। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। যিনি আমাকে চয়েস করতে দ্বিধান্বিত হননি, কোনো সমালোচনার স্বীকার হবেন সেটাও ভাবেননি।

আমি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হয়েছি চার বছর আগে। এই আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই হয়েছে, যেখানে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদের মতো বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আছেন। আমাকে দলের প্রচার-প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান করা হলো। যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন এইচ টি ইমাম। উনি রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিলেন। আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আমাকে নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে দিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহাসিক একটি দলে নির্বাচন কমিশনার হয়েছি এটাও আমার বড় পাওয়া। রাষ্ট্রপতি হওয়ার তিন মাস আগে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করতে গেলে উনি সালাম নিতেন না। আমি মন খারাপ করতাম, প্রধানমন্ত্রীর চরণধূলি পাই না। এ জন্য আমার মনের ভিতরে চরম মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কিন্তু তখন যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার নাম ‘প্রধানমন্ত্রীর মনে প্রোথিত হয়ে গেছে’ সেটা জানা ছিল না। উনি আমাকে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, আমিও চমক বলছি।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা চিনি, কিন্তু দেশবাসী তো তাকে চেনেন না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উনি একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রচারবিমুখ মানুষ। সে কারণে হয়তো অনেকেই চোনেন না। তিনি বলেন, আমি শুধু জেলার নেতা ছিলাম না। আমি জাতীয় নেতাও ছিলাম। বাংলাদেশের নেতাও ছিলাম। এমন কোনো স্ট্রেজ নেই, যা আমি পার করে আসিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৬৬ সালে যদি দেখা না হতো তাহলে হয়তো আমার ইতিহাস অন্য ধারায় লেখা হতো। জাতির পিতার ৬ দফা নিয়ে পাবনাতে গেলেন, প্রচার করতে। আমাকে বললেন, মাঠে আয়। আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। আমার মন থেকে বের হলো শিক্ষা শান্তি প্রগতি। এটা ছাত্রলীগের স্লোগান। সিনিয়র নেতারা আমাকে ছাত্রলীগের সদস্য হতে বললেন। ১৯৭০ সালে আমি ছাত্রলীগের সহসভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি সভাপতি, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে আমি আহ্বায়ক, পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি ২৩ মার্চ। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পারে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিই। ১৭ এপ্রিল যখন মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়, তখন আমিও ছিলাম সেখানে। মুক্তিযুুদ্ধে আমার অবিস্মরণীয় অবদান।

আমি রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল গঠন করলেন, তখন পাবনায় আমাকে জয়েন সেক্রেটারি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা। একমাত্র টেলিভিশনে দেখলাম, আমার নাম। এরপর শানে নুজুল জানার চেষ্টার করলাম। সে সময়ে আমি একটা কলেজের প্রভাষক। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কেন করল? উনি বললেন, তোমার মাস্টার্স এবং আইনের ডিগ্রিটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। কারণ, তুমি তো পড়ালেখা জানো। এরপর ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের মাধ্যমে খবরটি পাওয়ার পর আমরা প্রতিবাদ মিছিল বের করলাম। এরপর জেলার এসপি আমাকে বললেন, ঢাকায় বস বাহিনী মোশতাক সরকারের অনুগত স্বীকার করেছে। তোমরা আত্মগোপনে চলে যাও। এরপর ভারত চলে গেলাম। ফিরে এসে গ্রেফতার হলাম।

সর্বশেষ খবর