দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর রোডম্যাপ প্রকাশ করে। রোডম্যাপের বিষয়ে সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনার তখন একমতই ছিলেন। কিন্তু রোডম্যাপ প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ইসির দ্বিধাবিভক্ত মতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ তথা কর্মপরিকল্পনার অনেক বিষয় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে বদলি আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা নির্ভয়ে কোনো কাজ করতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন, সামনে সংসদ নির্বাচন; কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক থাকলে কোনো কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে না। নির্বাচনী রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এর প্রভাব পড়বে। সূত্র জানিয়েছে, ইসি সচিবালয়, কয়েকজন জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া ইসি সচিবালয় ছাড়া মাঠের কর্মকর্তারাও বদলি আতঙ্কে রয়েছেন। আবার সচিবালয়ে কাউকে কাউকে ডেস্ক ছাড়াও রাখা হচ্ছে। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসির রোডম্যাপে সংসদ নির্বাচনের ১৪টি চ্যালেঞ্জর কথা বলা হয়। আর চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায় নির্ধারণ করা হয় ১৯টি। কিন্তু গত ছয় মাসে উত্তরণের অনেক বিষয় থেকে ছিটকে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসি রোডম্যাপে বলেছিল, ‘প্রতিটি ভোটকক্ষে থাকবে সিসি ক্যামেরা, ইভিএম ব্যবহার হবে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে। সে ক্ষেত্রে কেবল মহানগর ও জেলা সদরের আসনগুলাতে ভোট ইভিএমে করার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া আরপিও ও নির্বাচনী আচরণবিধিতে সংশোধন করা এবং সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনে নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হয় রোডম্যাপে।’ তবে ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। নির্বাচনের মাত্র আট মাস বাকি থাকলেও এখনো সিসি ক্যামেরার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সরকারের কাছে কোনো প্রস্তাবও দেওয়া হয়নি ইসির পক্ষ থেকে। আরপিও সংশোধনও ঝুলে আছে। এ ছাড়া সংলাপে আসা সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও সেসব বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চলতি বছর ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণের টার্গেট রোডম্যাপে রাখা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন দলের নিবন্ধনের পাশাপাশি ইসির নিবন্ধিত দলগুলো বিধিবিধানের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্তের কথা রোডম্যাপে বলা হলেও তা থেকেও সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন। একইভাবে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে যাতে বিতর্কের মুখে পড়তে না হয়, সে জন্য আগের সীমানাকেই খসড়া আকারে প্রকাশ করেছে কমিশন। যদিও জনশুমারি হয়েছে। আবার প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক অখন্ডতা বজায় রাখার কথা একাধিকবার বলেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কোনো সীমানায় এবার হাত দিচ্ছে না ইসি। তবে ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সীমানা-সংক্রান্ত জটিলতা এড়িয়ে চলা এবং অনেকের তদবিরের কারণেই এবার সীমানায় হাত দেওয়া হচ্ছে না। ইসির দ্বিধাবিভক্ত মতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ তথা কর্মপরিকল্পনার অনেক বিষয় লন্ডভন্ড হয়েছে- এমন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, ‘লন্ডভন্ড তো একেবারেই হয়নি বরং আমরা রোডম্যাপ থেকে বেশ এগিয়েই আছি। রোডম্যাপ হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ, তাতে সময়ের প্রয়োজনে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কিছু পরিবর্তন আসতেই পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিধাবিভক্ত কিন্তু মন্দ কিছু ঈঙ্গিত করে না, বরং কমিশনাররা যে স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারেন তা প্রতিফলিত হয়। এটাই করপোরেট কালচার, গণতন্ত্রের ডিসেন্সি। সুচিন্তিত মতামত অভিন্ন হতে পারে বা ভিন্নতরও হতে পারে। ইভিএম ব্যহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার বিষয়ে ৬ এপ্রিল মাননীয় সিইসি মহোদয় বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা দিয়েছেন। এটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।’
আহসান হাবিব খান বলেন, ‘ভয়ভীতিহীন, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ তৎপর। নিজেদের মেয়াদের প্রথম বছরে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তাতে যেখানে বাধা-অনিয়মের অভিযোগ এসেছে সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগামীতে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমরা সব সময় আশ্বস্ত করতে চাই। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা দিয়ে পালন করব ইনশা আল্লাহ। পাশাপাশি সবার সহযোগিতাও কামনা করি। আশা করি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব।’
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ইসির রোডম্যাপ প্রণয়নের ফাইলে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার একমত পোষণ করলেও পরে সেসব বিষয় নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে নির্বাচন কমিশন। যদিও বিষয়টি সিইসি নিজেই বলেছেন ৬ এপ্রিল। ওই দিন সিইসি বলেন, ‘১২০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয় ইভিএম মেরামতের জন্য। তাতেও সরকার সম্মত হতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে ইভিএম নিয়ে আমরা (ইসি) দ্বিধাবিভক্ত হলাম। দুজন কমিশনার বললেন, ২৫-৩০টা ইভিএমে করে ফেলি। আমরা তিনজন বললাম- এটা অনিশ্চয়তা, এটা সমর্থন করছি না।’