সোমবার, ৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিরাপদ রক্তের সংকট

দেরিতে শনাক্ত হচ্ছে রোগী, স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে আসে মাত্র ৩২ শতাংশ রক্ত

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নিরাপদ রক্তের সংকট

দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত লাগে। এর কেবল ৩২ শতাংশ আসে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাকি ৬৮ শতাংশ আসে রক্তগ্রহীতার স্বজন ও অপরিচিতদের কাছ থেকে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের প্রতি মাসেই রক্ত দিতে হয়। রক্তের চাহিদা থাকায় অবৈধ ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত নিচ্ছে মানুষ। এতে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে বাড়ছে ঝুঁকি।  এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘সচেতনতা, শেয়ার, যত্ন : থ্যালাসেমিয়ায় যত্নের ফাঁক পূরণে শিক্ষাকে শক্তিশালী করা।’ দেশে বর্তমানে কত সংখ্যক থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে তার সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই। সচেতনতা বৃদ্ধির যে কার্যক্রম তা সবই দিবস কেন্দ্রিক। থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্ত রোগ। বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তাদের সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ থ্যালাসেমিয়ার রোগী হতে পারে। ফলে এক বছর বয়স থেকে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং প্রায় প্রতি মাসেই নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয় তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য। থ্যালাসেমিয়া সমিতির উপদেষ্টা হেমাটোলজিস্ট ও বোন-ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ফিজিশিয়ান    অধ্যাপক ডা. এম এ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে ৩০-৩২ ভাগ রক্ত পাওয়া যায় স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে থেকে। এ ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্তের প্রয়োজন রোগীর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে মেটানো হয়ে থাকে। সরকারিভাবে একটি জাতীয় কর্মসূচি বা টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রক্তের চাহিদার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ অনেক ব্লাড ব্যাংক গজিয়ে উঠেছে। এতে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন না হওয়ায় দুরারোগ্য রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা মূলত দুই ধরনের; মেডিকেল বা সাপোর্টিভ চিকিৎসা এবং নিরাময়মূলক বা কিউরেটিভ চিকিৎসা। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশে মাত্র ১০ শতাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসার আওতায় আসতে পারছে। দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য চিকিৎসা সহজলভ্য করতে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমকে সহায়তা দানে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।’ চিকিৎসকরা জানান, রক্তদান কতটা নিরাপদ এটা নিয়ে কারও কারও মধ্যে সংশয় রয়েছে। দৈহিকভাবে রক্তদানে কোনো ঝুঁকি নেই। পুরুষ ও নারীর (প্রাপ্ত বয়স্ক) ক্ষেত্রে ওজনের ৬৫ শতাংশ রক্ত থাকে বলে ধরে নেওয়া হয়। একজন মানুষের ওজনের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত রক্ত একবারে দান করতে পারেন। রক্ত সাধারণভাবে সংগ্রহ করা হয় ৪৫০-৫০০ মিলিলিটার। সেই হিসাবে রক্ত দান করলে শরীর থেকে বড় পরিমাণ রক্ত চলে যায় না। রক্ত পরিসঞ্চালন আইন অনুযায়ী, ৫০ কেজির ওপরে থাকলেই একজন মানুষ রক্ত দান করতে পারেন ৪৫০-৫০০ মিলি আর ৪৫ কেজি হলে ৩৫০ মিলি। ফলে রক্তদানে শারীরিক ক্ষতি হওয়ার কোনো শঙ্কাই নেই। ২০১৯ সালে সারা দেশে ৯ লাখ ৪২ হাজার ১৭২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে গ্রহীতাদের দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে তা কমে ২০২০ সালে সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ ব্যাগে। ২০২১ সালে সাড়ে ৭ লাখ রক্ত সংগ্রহ করে গ্রহীতাদের দেওয়া হয়েছে। রক্তদাতাদের ৭০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩০ শতাংশ নারী। দেশের নারীদের মধ্যে অপুষ্টি, ওজন কম থাকা, হিমোগ্লোবিন কম থাকাসহ নানা সমস্যার কারণে রক্তদানে তাদের অংশগ্রহণ কম।

রক্তস্বল্পতা, ওজন কম, অস্বাভাবিক রক্তচাপ, হেপাটাইটিস বি ও সি, ম্যালেরিয়া, এইডস অথবা কোনো যৌনরোগাক্রান্ত, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহণকারী ব্যক্তিরা রক্তদান করতে পারেন না। কম ঝুঁকিপূর্ণ রক্তদাতা থেকে রক্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং পরীক্ষার মাধ্যমে যে রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়, তাকে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বলে। নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে একজন রক্তদাতা শারীরিক সুস্থতার পাশপাশি হৃদরোগ, স্ট্রোকের মতো প্রাণহরণকারী রোগ থেকেও নিরাপদ থাকতে পারে। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলেও অনেকে এ বিষয়ে অবগত নয়। সাধারণত কম ঝুঁকিপূর্ণ রক্তদাতা নির্বাচন ও রক্ত সংগ্রহ, সব রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে বাধ্যতামূলক হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিস এই পাঁচটি স্ক্রিনিং করা, অপ্রয়োজনে রক্ত পরিসঞ্চালন না করা এবং রক্তের সঠিক ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করাই নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কৌশল। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বছরে প্রায় ৯ লাখ ব্যাগের বেশি রক্ত সংগ্রহ করা হয় এবং চাহিদা এর দ্বিগুণের বেশি। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রতি মাসে এক-দুবার রক্ত দিতে হয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের বারবার জ্বর আসে, খেতে চায় না। চিকিৎসকরা অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক দেন। আমাদের দেশে রেফারেল ব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসক কোনো রোগ সন্দেহ করলেও ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে রেফার্ড করতে পারেন না। ফলে রোগী শনাক্ত হতে দেরি হয়। এ ছাড়া অধিকাংশ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া শনাক্তে প্রয়োজনীয় হিমোগ্লোবিন-ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। বেসরকারিভাবে এ টেস্ট করতে খরচ হয় প্রায় ৩ হাজার টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া রোগীরা সাধারণত যার সঙ্গে রক্তের মিল হয় তার কাছ থেকেই রক্ত নেন। রক্তের গ্রুপের মিল থাকলেও ধীরে ধীরে রোগীর শরীরে নানা রকম এন্টিবডি তৈরি হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্তদাতার সঙ্গে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য মিললে তবেই রক্ত নেওয়া নিরাপদ হবে। এ জন্য ১০-২০ জন নির্বাচন করে তাদের কাছেই ঘুরে ফিরে রক্ত নিতে হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা রক্তের সংকটে ভোগে। এদিকে হাসপাতালগুলোতে প্রচুর রক্তের অপচয় হয়। দেখা যায়, অপারেশনের জন্য পাঁচ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে রোগীর স্বজনদের কাছে। এর মধ্যে দুই ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে; বাকিটা ফেলে দেওয়া হচ্ছে। রক্তের অপচয় রোধে সচেতন হতে হবে সবাইকে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর