নির্বাচনের বছরে ‘নির্বাচনী বাজেট’ এমন হওয়ার কথা- যেখানে ভোটারতুষ্টির জন্য থাকবে নানা উদ্যোগ। তবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করায় প্রস্তাবিত বাজেটে ভোটারকে তুষ্ট করার ‘প্রাণখোলা’ উদ্যোগ নিতে পারেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি চলমান বৈশ্বিক সংকট, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তুলে ধরে তা সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের গৃহীত উদ্যোগ তুলে ধরেছেন। মৃদুভাবে কিছু নতুন পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে যে রকম প্রতিশ্রুতির ঝোলাপূর্ণ বাজেট হওয়ার কথা, নানা চাপের কারণে এবার সচেতনভাবেই হয়তো তা এড়িয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। ঘোষিত বাজেটে বরং এসব চাপ সামলাতে মধ্যমেয়াদে কিছু সম্ভাবনার কথা বলেছেন তিনি।
একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনী বাজেটের তুলনা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যে বাজেটটি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তার শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’। তখনকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট ৫ বছরের মাথায় এসে হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্বাচনী বাজেটের তুলনায় প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন নির্বাচনী বাজেট ঘোষণা করেছেন। শিরোনাম দিয়েছেন- ‘উন্নয়নের অভিযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’। আর এই অগ্রযাত্রায় নতুন প্রজন্মকে সাথী করার ইচ্ছাপোষণ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
আছে চাপ আছে সম্ভাবনা : বিশ্লেষকরা বলছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে যে পরিবেশ ছিল, তার তুলনায় চাপ বহুগুণে বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট এমন এক সময় ঘোষণা করা হচ্ছে যখন সরকারের সামনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ; নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে কূটনৈতিক চাপ; রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের চাপ; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার চাপ; ডলার সংকট কাটিয়ে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য আমদানির চাপ; মূল্যস্ফীতি সহনীয় রেখে দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার চাপ, নির্বাচনের আগে ভোটার তুষ্টির চাপ; সর্বোপরি আইএমএফ-এর শর্ত পালনের চাপ। এত সব চাপের মধ্যে সরকারকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি অর্জন করতে হবে; অর্থনীতি সচল করতে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে; এ জন্য বিনিয়োগ লাগবে প্রায় ১৬ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশে; অর্থাৎ ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ আনতে হবে ব্যক্তি খাত থেকে। আর বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে।
ঘোষিত বাজেটে উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি : সামষ্টিক অর্থনীতির এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাজেটে প্রচলিত আর্থিক উদ্যোগের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছে ব্যয় সংকোচন নীতি অব্যাহত রাখা; উন্নয়ন প্রকল্পে অপচয় কমানো; কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়াতে সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা; বিদ্যুৎ, গ্যাসে ভর্তুকি বাড়ানো; মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো; নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষায় টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে কার্ডে নিত্যপণ্য সরবরাহ এবং বিনামূল্যে বা ভর্তুকিমূল্যে দরিদ্র মানুষের সুরক্ষায় খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
চলমান এসব উদ্যোগের ফাঁকে কিছু প্রতিশ্রুতি কিছু সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন বাজেটে। দারিদ্র্য হ্রাস ও সাম্যভিত্তিক সমতাগঠনে গৃহ নির্মাণ, কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়েছেন; কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন; বাড়িয়েছেন বয়স্কভাতা ও বিধবা ভাতা; সাধারণ মানুষের করের বোঝা কমাতে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকায় উন্নীত করেছেন। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নের ঘোষণাও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে ভোটার তুষ্টির প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। তবে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি আইএমএফ-এর শর্তপূরণের লক্ষ্যে বাজেটে রাজস্ব বাড়াতে কিছু অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে ২ হাজার টাকা ট্যাক্স বাধ্যাতামূলক করা হয়েছে; ভ্রমণপ্রিয় বাংলাদেশির ভ্রমণকরও বাড়ানো হয়েছে।
কিছু প্রস্তাব কিছু প্রশ্ন : ঘোষিত বাজেটে কিছু প্রস্তাবকে সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রার বাজেট হলেও দেশে তৈরি মোবাইল ফোন এবং আমদানিকৃত অপারেটিং সিস্টেম ও ডাটাবেজ সফটওয়্যারের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। রাজস্ব বৃদ্ধির এসব উদ্যোগ স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী সংকটের মুখে দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের ঘোষণা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে জিডিপির অনুপাতে এটি কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩ শতাংশের ওপরে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা : নতুন বাজেটে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাসও রয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনী বাজেট ঘোষণার আগে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের কার্যক্রম চলমান ছিল। আগামী নির্বাচনের আগে এ দুটি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, যার সুফল পাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আরেক মেগা প্রকল্প কর্ণফুলী টানেলের কাজও প্রায় শেষের পথে। এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাতীয় গ্রিডে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে। বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কর্ণফুলী টানেল ও ঢাকা বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর অদূরে কুতুবখালি পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অচিরেই চালু হবে; রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের মতো আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে; আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোদমে চালু হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব সম্ভাবনার কথাই বলা হয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের জয়গান : বাজেটের চমৎকৃত দিক হচ্ছে- তরুণ প্রজণে¥র ভোটারদের আকৃষ্ট করার প্রতিশ্রুতি। এমনকি স্মার্ট বাংলাদেশে কর্মতৎপর তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল বরাদ্দ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তরুণদের নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ কর্মক্ষম এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২৮ শতাংশ তরুণ। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা তারুণ্যের শক্তিকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম। তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আগামী দিনগুলোতে তরুণরাই হবে উন্নত বাংলাদেশের পথে আমাদের স্মার্ট অভিযাত্রার অন্যতম সারথী। এই স্মার্ট বাংলাদেশের চেহারা কেমন হবে- ঘোষিত বাজেটে সে সম্পর্কেও কিছু ধারণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, ‘আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার; দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ; চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়; মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪ থেকে ৫ শতাংশে; রাজস্ব জিডিপির অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে; বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ; শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা বাড়বে; সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে স্বাস্থ্যসেবা; স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগব্যবস্থা, টেকসই নগরায়ণসহ নাগরিকদের সব সেবা থাকবে হাতের নাগালে; তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি; সবচেয়ে বড় কথা স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় নানামুখী চাপ ও সংকট সামাল দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের এই প্রতিশ্রুতি, এই সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। আবার নানামুখী চাপ সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনে উৎসাহ জোগাতে পারে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাজেট বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। বহুজাতিক কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপন টিভিতে দেখা যায়, যার মূল কথা হচ্ছে- ‘দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে দাগই ভালো।’ দ্বাদশ নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কেও তাই বলা যায়- চাপ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে চাপই ভালো...।