আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সামনে কঠিন নির্বাচন হবে। চ্যালেঞ্জ আসবে, ঐক্যবদ্ধ থাকুন, ইনশা আল্লাহ আমরাই জিতব। উন্নয়ন-অর্জনের কারণে জনগণ আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবে। দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও বর্তমান এমপিদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বরাবরই বলে আসছি, মুখ দেখে নয়, জরিপ দেখেই মনোনয়ন। সেটাই করব। এখানে আমার দলের (আওয়ামী লীগের) প্রার্থীর শুধু জনপ্রিয়তা দেখব না, ওরাও (বিএনপি) নির্বাচনে আসবে। তাদের প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কেমন সেটা দেখেও নৌকা দেব। কারণ জিতে আসার মতো সব ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে।
গতকাল দুপুরে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে বৈঠকের শুরুতে সভাপতির সূচনা বক্তব্যের সময় গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। এরপর আট সাংগঠনিক সম্পাদক যথাক্রমে আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, শফিউল আলম নাদেল, আফজাল হোসেন তাঁদের বিভাগীয় রিপোর্ট উপস্থাপন করেন।
বৈঠকসূত্র জানান, বৈঠকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের রিপোর্টে অনেক জেলা-উপজেলা এবং দলীয় এমপিদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের কোন্দলের চিত্র উঠে আসে। দলীয় এমপিদের সঙ্গে নেতাদের দূরত্ব প্রকাশ পায়। একইভাবে দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে নেতাদের বিষোদগারের বিষয়টিও দলীয় সভানেত্রীর দৃষ্টিতে আনা হয়।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এমপিদের বিরুদ্ধে কথা না বলে দলের উন্নয়ন প্রচার করতে হবে। সংগঠন চাঙা করতে হবে। কার কেমন জনপ্রিয়তা আছে, সে তথ্য আমার কাছে আছে। আমি নিয়মিত জরিপ করছি। তিনি বলেন, সবাইকে মনে রাখতে হবে, সামনের নির্বাচনটা অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। কাজেই মুখ দেখেই কাউকে মনোনয়ন দেব না। এমপি আছেন বলেই যে আবার মনোনয়ন দেব, এটা হবে না। আর বড় নেতা বলেই যে তাকে মনোনয়ন দেব সেটাও না। জরিপে যার বিজয়ী হয়ে আসার মতো যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ওরা (বিএনপি) নির্বাচনে আসবে। কাজেই প্রতিপক্ষ প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কেমন সেটাও কিন্তু দেখা হবে। অন্য দলের প্রার্থীর জনপ্রিয়তা দেখেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনের তাগিদ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারে না, চার সিটি নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার না করে সরকারের সাড়ে চৌদ্দ বছরের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরুন। তাহলে দেশের জনগণ আমাদেরই ভোট দেবে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা। আমার দেশ নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। দেশের সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়েই নির্বাচন হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। জনগণ যাদের পছন্দ তাদেরই বেছে নেবে। তবে আমি বিশ্বাস করি দেশের জনগণ আর অন্ধকার যুগে ফিরে যেতে চায় না।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মেরিনা জাহান কবিতা তার ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চয়ন ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন। মেরিনা তার বক্তব্য শুরু করেন শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে কবিতা দিয়ে। এরপর তিনি অভিযোগ জানান, তার এলাকায় কয়েকটি ইউনিয়ন কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি কিছু জানেন না। নেত্রী আপনি কামাল (রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বে সাংগঠনিক সম্পাদক) ভাইকে নির্দেশ দেন যেন না ভাঙে। এ সময় ‘এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘নেত্রী, এটা তাদের ভাই বোনের বিষয়। আমি আর কী বলব! আপনি এর সমাধান করে দেন।’ এ সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন তো কোনো কমিটিই ভাঙা যাবে না। আর কমিটি ভেঙে দিতে হলে তো কেন্দ্রের অনুমোদন নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন করে কোনো জেলা-উপজেলার সম্মেলনের আয়োজন করার দরকার নেই। যেগুলোর ইতোমধ্যে তারিখ হয়েছে, সেগুলোর সম্মেলন হবে। আর যেসব জায়গায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে।’
খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের প্রতিবেদনে শৈলকুপা উপজেলায় আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলের বিরুদ্ধে একটি মন্দির ভাঙার অভিযোগের কথা তুলে ধরেন। এ সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জানতে চান, ‘কে জড়িত?’ বি এম মোজাম্মেল জানান, ‘শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংখ্যালঘুর সম্পত্তি দখলের অভিযোগ আসবে তাদের নির্বাচনে মনোনয়ন বা দলীয় কোনো পদ দেওয়া হবে না।’
সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, একাধিক নেতার বক্তব্যে তৃণমূলের এমপিদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে আসে। একজন নেতা জানান, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এলাকায় গিয়ে এমপিদের বিরুদ্ধে বলছেন। এটা বন্ধ না হলে দলের জন্য বিপদ বাড়বে।
শাজাহান খান-বাহাউদ্দিন নাছিম বাহাস : রুদ্ধদ্বার বৈঠক শুরু হলে কথা বলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান। তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উত্থাপন করেন। মাদারীপুরে বাহাউদ্দিন নাছিমের কারণে আওয়ামী লীগ সংগঠন বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন শাজাহান খান। এ সময় বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘যেহেতু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, আমাকে অক্রমণ করা হয়েছে, সেজন্য আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন মাননীয় নেত্রী।’ প্রধানমন্ত্রী তখন বাহাউদ্দিন নাছিমকেও বলার সুযোগ দেন। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘শাজাহান খান আওয়ামী লীগকে এখন জাসদ বানিয়ে ফেলেছেন। তার অত্যাচারে আওয়ামী লীগই অতিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিতরা আজ শাজাহান খানের অত্যাচারে বহিরাগততে পরিণত হয়েছে। তারা নিষ্পেষিত হচ্ছে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাহাউদ্দিন নাছিমকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি এবং দাদা ভাই (ইলিয়াস চৌধুরী, লিটন চৌধুরীর পিতা) শাজাহান খানকে আওয়ামী লীগে নেওয়ার জন্য আমার মাথা খারাপ করেছিলে। আমাকে সারাক্ষণ এ জন্য অনুরোধ করেছিলে। এখন তুমিই বিরোধিতা করছ। শাজাহান খান যখন জাসদে ছিল, তখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। শাজাহান খান বলেছিল যে, কোন পরিস্থিতিতে জাসদে গেছে। তার পিতা এবং শাজাহান খান দুজনেরই অবদান রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী দুজনকেই শান্ত থাকার এবং পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এখন মিলেমিশে কাজ করার সময়। এখন ঝগড়াঝাটি করার সময় নয়’- এ বলে দীর্ঘক্ষণ বিতর্কের অবসান ঘটান প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এলাকায় গিয়ে এমপিদের বিরুদ্ধে চরিত্র হনন করতে নিষেধ করেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন স্বচ্ছ হয়, তার প্রমাণ দিয়েছি : শেখ হাসিনা
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন স্বচ্ছ হয়, নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারে। সেই ব্যবস্থা যে আমরা করতে পারি, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি। আওয়ামী লীগের ভোট চুরি করা লাগে না। এটা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। গতকাল দুপুরে গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভার সূচনা বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। সূচনা বক্তব্যের পর শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক শুরু হয়। সেখানে আগামী নির্বাচন, তৃণমূল থেকে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা, নির্বাচনী এলাকায় বিরোধ নিষ্পন্নসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিদেশি দেশগুলোকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেসব দেশ আমাদের নির্বাচনের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তাদেরও বলব আমাদের যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা উপনির্বাচনগুলো হলো, সেই নির্বাচনগুলো দেখেন কীভাবে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। এরপর আবার কেন প্রশ্ন ওঠে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করে। সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন, তাঁর সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। এর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে পারে না।