ব্যাপক সমালোচনা ও তীব্র বিরোধিতার মুখে টিআইএন থাকলেই রিটার্ন দাখিল করতে হবে এবং ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে- এমন প্রস্তাব বাতিল করে জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে আয়কর আইন। এবার বিষয়টি প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ বাজেটের (অর্থবিল-২০২৪) থেকেও প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হতে পারে- বিশেষজ্ঞদের এমন দাবি এবং জনপ্রতিনিধিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ২৫ জুন সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হবে অর্থবিল। পরদিন ২৬ জুন প্রস্তাবিত এ বাজেট পাস করা হবে। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়। এ রিটার্ন জমার স্লিপ পেতে করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর আদায়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাবকে দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে সমালোচনা করেছিলেন। ‘ন্যূনতম করের ধারণাটি করের নীতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ’ জানিয়ে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেয়। একই সঙ্গে ন্যূনতম কর প্রত্যাহারের দাবি জানায় এফবিসিসিআই। তাদের এ দাবির প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রীরও সায় রয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর চলমান মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ন্যূনতম কর আদায়ের প্রস্তাব বাতিল করতে বলেছেন তিনি। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলপয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এ প্রস্তাবের বিষয়েও অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে এ সিদ্ধান্ত থেকে সম্পূর্ণ সরে না এলেও এখানে আংশিক পরিবর্তন আনে এনবিআর। যদিও শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষার মূল উপকরণের ওপর কোনো ধরনের ভ্যাট আরোপ করা উচিত নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে বলপয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলেও এখন তা কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বলপয়েন্ট কলমের ওপর কোনো ধরনের ভ্যাট আরোপিত ছিল না। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষার মৌলিক উপকরণের ওপর ভ্যাট আরোপ করা যুক্তিসংগত নয়। এতে শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর চাপ পড়বে বলে মনে করেন তারা। আইনপ্রণেতাদের এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তারা। জানা গেছে, ১ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে সরকারকে ন্যূনতম কর প্রদান করে সরকারের জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এ ধরনের অংশীদারিমূলক অংশগ্রহণ দেশের সক্ষম জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারণের লক্ষ্যে করমুক্ত সীমার নিচে আয় রয়েছে, অথচ সরকার থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নের বাধ্যবাধকতা আছে, এমন করদাতাদের কাছ থেকে ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা আদায়ের প্রস্তাব করেন তিনি। সূত্র জানান, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী ন্যূনতম কর আরোপের বিধান বিলোপের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এনবিআর সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চূড়ান্ত বাজেটে সেই প্রভিশনটি বাতিল করবে। অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে কারও রিটার্ন জমার স্লিপ প্রয়োজন হলে আগের নিয়মে শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। কেবল করমুক্ত সীমা ওপরে আয় থাকলে স্ল্যাব অনুযায়ী আয়কর দিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ৪৪টি সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিলে; কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে; আমদানি-রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি-ইআরসি) নিতে; সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে; সমবায় সমিতি নিবন্ধন নিতে; বীমা কোম্পানির সার্ভেয়ার হতে; ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাটের দলিল করতে; ক্রেডিট কার্ড নিতে; পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ নিতে; ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র পেতে; গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে; ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করতে; কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিতে; অস্ত্রের লাইসেন্স নিতে; ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে; নির্বাচনে অংশ নিতে; সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১৬ হাজার টাকা হলে; এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করলে; পণ্য আমদানি-রপ্তানির বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক।
বাজেট ঘোষণার পর অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ন্যূনতম কর বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এফবিসিসিআই থেকে এনবিআরে পাঠানো সুপারিশে বলা হয়েছে, আয়ের ওপর কর আরোপের মৌলিক ধারণার সঙ্গে ন্যূনতম করের বিষয়টি সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। নির্ভরযোগ্য হিসাবের ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ডে মোট আয়ের ওপর কর আরোপের মূলনীতি অব্যাহত রাখতে হবে।