রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাত হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এ হৃৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হৃৎপিণ্ডে যদি রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক না থাকে তাহলে সে দেশের অর্থনীতি ভালো চলে না। আমাদের দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ব্যাংকিং আলমানাক নামের এক পুস্তকের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আন্তর্জাতিক ঋণমানে আমাদের অবনতি হয়েছে। এখন শুধু বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ বললেই চলে না। বিশ্বে অনেকগুলো ক্রেডিট রেটিং সংস্থা রয়েছে। তাদের কথাও শুনতে হয়। আমাদের দেশের অর্থনীতির ভাবমূর্তিও ঠিক নেই। ব্যাংক খাতের ঋণ অবলোপন মানেই ঋণগ্রহীতা বা ঋণখেলাপির দায়মুক্তি নয়। অথচ সেটা দায়মুক্তির মতোই হয়ে গেছে। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। সে হিসাব ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালান্স সিট থেকে বাদ দিচ্ছে। কিন্তু ঋণটা তো জনগণের কাঁধেই বর্তাচ্ছে। জনগণকে এটা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর্থিক খাত অন্যান্য দশটি খাতের মতো নয়। কেননা এখানে গ্রাহকদের আমানতকারীদের আমানত রয়েছে। তাদের প্রতি ব্যাংকগুলোর দায়বদ্ধতা আছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কী হচ্ছে-একই পরিচালক বছরের পর বছর বোর্ডে থেকে যাচ্ছেন। তারা ইচ্ছামতো ঋণ নিচ্ছেন। আবার তা পরিশোধও করছেন না। ব্যাংক খাতের কেন এমন দুরবস্থা হলো। এটা তো এক দিনে হয়নি। এটার জন্য সেন্ট্রাল ব্যাংক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। ঋণখেলাপিরা খুবই প্রভাবশালী। তারা রাজনৈতিক প্রভাবও খাটান। বিভিন্ন সময় ব্যাংক খাতের সংস্কার হয়েছে। তবে এসব সংস্কার সঠিক ছিল না। একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে আমিও ছিলাম। তখন আমরা ৬০-৭০ জনকে ব্যাংক থেকে অপসারণ করেছিলাম। আরও কয়েকজন ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ তারা অন্যায় করেছিলেন। বড় ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের স্কিম হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের আস্থা ওঠে যায়নি। কারণ গ্রাহকরা বিশ্বাস করে ব্যাংক বসে গেলে সরকার তাদের টাকা ফেরত দেবে। যারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেন তারা ফেরত না দেওয়ার জন্যই ঋণ নেন। একসময় অনিয়ম করলে বিচার হতো। এখন তা হয় না। একজন পরিচালক বছরের পর বছর ব্যাংকের পরিচালক। আবার একই পরিবারের অনেক সদস্য আজীবন ব্যাংকের পরিচালক। এসব নিয়মনীতির সংস্কার হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছিল ভুল সংস্কার।

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। কিন্তু এ দেশের বাস্তবতা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বোঝে না। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান। হার্ট ভালো থাকে রক্ত সঞ্চালনের কারণে। আজ আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভালো অবস্থানে নেই। বাংলাদেশের ঋণমানে আন্তর্জাতিকভাবে যে অবনতি হয়েছে তা আর্থিক খাতের কারণেই হয়েছে।

তিনি বলেন, একটা সময় ব্যাংকে রোডম্যাপ ছিল কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সেগুলো সব চলে গেছে। এখন আবারও কেন সেই বিধিবিধানের কথা বলা হচ্ছে, ঋণখেলাপির সংজ্ঞা আরও আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে? রোডম্যাপ যে করা হচ্ছে, সেই রোডম্যাপ দিয়ে আমরা কতদূর আসলাম, কী কারণে সেখান থেকে বিচ্যুত হলাম, কখন হলাম তার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তার যৌক্তিক কারণ না বুঝে আবারও রোডম্যাপ করলে কোনো কাজ হবে না। সুদহার বেঁধে দেওয়ার বিষয় নিয়ে খুবই আলোচনা হচ্ছিল। এই সুদহার এক জায়গায় বেঁধে দেওয়া হবে কি না, সেটা ৬ বা ৯ শতাংশ হবে ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে নাকি সম্পূর্ণ উদার করে দেওয়া হবে, ঋণ ও আমানতের চাহিদা অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ হবে ইত্যাদি। এটা একসময় করা হয়েছিল, তখন এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছিল এর পক্ষে-বিপক্ষে। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলেছিল এটা (সুদহার) উদারীকরণ করা হোক। সেই উদারীকরণ করার পর নয়-ছয়ে আবারও বেঁধে দেওয়া হলো। অনেক দিন ধরে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, উচিত ছিল তার আগেই ছেড়ে দেওয়া। আবার যখন সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া হলো তখন আগের সব যুক্তি আমরা ভুলে গেছি। তিনি বলেন, শুধু আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝে না। একবারে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে যেগুলো ছোট ছোট ব্যাংক, যারা নাজুক অবস্থায় আছে, যারা আমানত পায় না, তারা তো গ্রাহককে আমানতের জন্য বেশি সুদহার দিয়ে আকৃষ্ট করতে চাইবে। যারা খুব নিরাপদ ঋণগ্রহীতা না, রিস্কি ঋণগ্রহীতা, তাদের ঋণ দিয়ে আপাতত বেঁচে থাকতে চাইবে। সেখানেও সমস্যা তৈরি হবে। এটার আপাতত একটা সীমা থাকা দরকার। কারণ ঋণের সুদহারে যদি ঊর্ধ্বসীমা না থাকে তাহলে ওই ঋণগ্রহীতারা যারা ঋণ নিচ্ছেন তারা হয় খুব ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নেবেন অথবা যারা মনে করেন ঋণ নিচ্ছি আর ফেরত দেব না তাদের কাছে তো সুদের হার কোনো বিষয় না। আমাদের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। নতুন প্রজন্মের ব্যাংক নিয়ে তিনি বলেন, তিন বছর আগে যে ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালীদের, সেই ব্যাংকগুলো যে খুব বেশি আমানত সংগ্রহ করতে পারিনি এটা ঠিক। ১ হাজার কোটি টাকার আমানতও অনেকে সংগ্রহ করতে পারেনি। এভাবে তারা টিকে থাকতে পারবে না। এখন প্রশ্ন উঠেছে ওই ব্যাংকগুলো আবার একত্রিত করা হোক বা কমিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এই ব্যাংকগুলোকে যখন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তখন বহুবার আমরা বলেছি বাংলাদেশের মার্কেটে এত বেশি জায়গা নেই। এটা এতদিন পর বুঝতে পারল কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়েছিল বলে মনে করল তারা। আমানতকারী নিয়ে তিনি বলেন, একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, যে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের দিক থেকে বড় সেগুলোতে বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। তারপরও এগুলোতে আমানত কমেনি। তার মানে এগুলোতে আমানতকারীরা কোন ব্যাংকে কেলেঙ্কারি হচ্ছে সেটা দেখেন না। একটা অলিখিত নিয়ম দেখেন আমানতকারী যে, ব্যাংকে টাকা রেখেছিল সরকার আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আছে তারা রক্ষা করবে। এখন ব্যাংকে রক্ষা করতে হয় কারণ আমাদের মতো দেশে দু-একটা ব্যাংক উঠে গেলে আমানতকারীর বিরাট ক্ষতি হবে ও ব্যাংকের ওপর থেকে আস্থা চলে যাবে। এতে পুরো ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো না কোনোভাবে ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হয়। তবে এটা সব সময় টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

সর্বশেষ খবর