কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে টানা সহিংসতা শেষে বিরতির পর আবার বিক্ষোভের চেষ্টা করেছে শিক্ষার্থীরা। ডিবি হেফাজত থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণার পর রবিবার রাতেই বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ। ঘোষিত সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবেই গতকাল ঢাকার বিভিন্ন স্পটে বিক্ষিপ্তভাবে বিক্ষোভ করতে নামেন তারা।
তবে আগে থেকে কঠোর অবস্থানে থাকা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় কোথাও দাঁড়াতে পারেনি তারা। ধানমন্ডি, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, ইসিবি চত্বর, পল্টনসহ কয়েকটি এলাকা থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে বিক্ষোভ হয়েছে। চট্টগ্রামের বিক্ষোভ সংঘর্ষে রূপ নেয়।
ডিবি কার্যালয়ে ৬ সমন্বয়ক : গত রবিবার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে কিছু সময়ের মধ্যে তা প্রত্যাখ্যান করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। লিখিত বিবৃতি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিরপুরের ইসিবি চত্বর, সায়েন্স ল্যাব, পল্টন, ধানমন্ডি স্টার কাবাব, নিউমার্কেট, বাড্ডার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, মিরপুর ১০ নম্বর এবং সেগুনবাগিচায় জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় পুলিশ তাদের ধাওয়া দিলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ সময় ওই সব এলাকার কিছু সড়ক বন্ধ করে যানচলাচলের জন্য ডাইভারশন করে দেয় পুলিশ। ঢাকায় যেসব এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণার কথা ছিল, সকাল থেকে সেসব এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র?্যাব, বিজিবি এবং কোথাও কোথাও সেনা টহলও দেখা গেছে। পাশাপাশি র?্যাবের হেলিকপ্টারের টহলও দেখা গেছে।
বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে : পুলিশ দাবি করেছে, তারা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছিল। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সি সাব্বির বলেন, সকাল থেকেই মিরপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ মোতায়েন ছিল। এ সময় সন্দেহভাজন ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে মিরপুরের ইসিবি চত্বরে শিক্ষার্থীদের ৫০-৬০ জনের একটি দল জড়ো হয়ে বিক্ষোভের চেষ্টা করে। তবে পুলিশ ছিল সেখানে ২ শতাধিক। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়, লাঠিপেটা করে। শিক্ষার্থীরা গলিতে ঢুকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনেও বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছে আন্দোলনকারীরা। তবে বিক্ষোভ শুরুর আগেই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় ধানমন্ডি-১, ২-সহ বিভিন্ন সড়কে পুলিশ তল্লাশি শুরু করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার মো. রেফাতুল ইসলাম বলেন, ধানমন্ডি এলাকা থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবে শিক্ষার্থীরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে দুপুরে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। মেরুল বাড্ডায় গতকাল সকাল ১০টা থেকে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে সহিংসতার পর আবারও কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। সে পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাক বিশ্বদ্যিালয়ের সামনে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। তবে সেখানে পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে শিক্ষার্থীরা সমবেত হতে পারেননি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সামনে ও আশপাশের এলাকা থেকে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। এ বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন গাজী বলেন, এই তিনজনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাড্ডা ছাড়াও পল্টন মোড় ও শাহবাগ এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ চারজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
সমন্বয়কদের জিম্মি করে বিবৃতি আদায়ের অভিযোগ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে জিম্মি করে বিবৃতি দেওয়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সামনে অবস্থান নিয়ে এসব অভিযোগ করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, শিক্ষার্থীদের রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হতাহত করা হয়েছে। অনেককে পঙ্গু করা হয়েছে। পাঁচ সমন্বয়ককে ডিবি ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে জিম্মি করে বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছে। তাদের দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করার কথা বলানো হয়েছে। আমরা শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলন বন্ধ করতে পারি না। আমাদের সহকর্মীদের হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।
আন্দোলনকারী আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ডিবি অফিস থেকে আসা যে কোনো ধরনের বিবৃতি শিক্ষার্থী সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ৯ দফা দাবি আদায় না হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করা হচ্ছে। দিনের বেলায় নাটক করে রাতের বেলায় মেসে মেসে তল্লাশি, আটক-গ্রেপ্তার করছে। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ছাত্রদের হেনস্তা করছে, মোবাইল চেক করছে, এই ক্ষমতা তাদের কে দিয়েছে? কেন তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে? অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারসহ বিজিপি-সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা পুরোনো ৯ দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। জাবি প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকাল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-সংলগ্ন সড়ক থেকে একটি মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সড়ক ঘুরে ফের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গিয়ে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ডিবি পুলিশ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সমন্বয়কদের দিয়ে আন্দোলন বন্ধ ঘোষণা করিয়েছে, আমরা সেটা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা চাই, আগে সব সমন্বয়ককে মুক্তি দেওয়া হোক, তারপর সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেব।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রেজাউল রকিব প্রমুখ।
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান : কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারীদের গুম, খুন, মামলায় জড়ানোর প্রতিবাদে চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগী পাহাড় এলাকায় সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর আগে জামালখান প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও পুলিশি অবস্থানের কারণে স্থান পরিবর্তন করে চেরাগী পাহাড় এলাকায় বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় সমাবেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী করতে পারেনি। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিপেটার মাধ্যমে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গতকাল নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ-সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন- সিএমপির কোতোয়ালি জোনের এসি অতনু চক্রবর্তী, কোতোয়ালি থানার এসআই মোশাররফ হোসেন, এসআই বোরহান উদ্দীন, দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আকমল হোসেন ও নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন আবু জাবেদ। এ ছাড়াও আটক করা হয়েছে ২০ জনকে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী তারেক আজিজ বলেন, নগরের জামালখান ও চেরাগী মোড় থেকে কোতোয়ালি থানা পুলিশ ২০ জনকে আটক করেছে। যাচাইবাছাই করা হচ্ছে, যদি তারা সাধারণ শিক্ষার্থী হয়ে থাকে তাহলে ছেড়ে দেওয়া হবে। যদি দেখা যায়, তারা আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী তাহলে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে। এ ঘটনায় আন্দোলনকারীদের ছোড়া ককটেলে আমাদের এসি কোতোয়ালি অতনু চক্রবর্তী, এসআই মোশাররফ হোসেনসহ চারজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় থানায় মামলা করা হবে। সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা জামালখান প্রেস ক্লাব চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দেন বিকাল ৩টার সময়। এর আগে থেকে জামালখান মোড়, প্রেস ক্লাব, গণি বেকারি, চেরাগী পাহাড়সহ গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন, বিজিবি ও এপিবিএন অবস্থান নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহজনক কাউকে দেখলে তার মোবাইল পরীক্ষা করেন। এ সময় জামালখান মোড় থেকে মোবাইল পরীক্ষা করে আটজনকে আটক করা হয়। তারা হলেন- সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইমন, বাকলিয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির আজমাঈন করিম নিহাল ও গাছবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের জুলহাজ হোসেন। আটক বাকি আন্দোলনকারীর নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। এরপর জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমনের নেতৃত্বে চেরাগী পাহাড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মিছিলটি নগরীর জামালখান ঘুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েক মিনিট অবস্থান শেষে পুনরায় চেরাগী পাহাড় চলে যায়। সেখানে রাস্তার পাশে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান করেন। তবে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে চেরাগী পাহাড় মোড়ে অবস্থান নেন শতাধিক আন্দোলনকারী। এ সময় পুলিশ দুজনকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে তুলতে চাইলে বিক্ষোভকারীরা বাধা দেন। তারা প্রিজন ভ্যানের সামনে সড়কের ওপর বসে পড়েন। এরপর বিক্ষোভকারীরা মোড়ের এক পাশে সড়কে বসে স্লোগান দিতে থাকেন। এভাবে ১৫ মিনিট বসে থাকার পর পুলিশ দুটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের পর বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এরপর পুলিশ লাঠিপেটা করে সবাইকে সরিয়ে দেয়। এ সময় কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোশাররফ চোখে আঘাত পেয়েছেন। এ ছাড়াও একই সময় কোতোয়ালি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার অতনু চক্রবর্তীসহ একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন। পরে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিলে তারা নগরের রহমতগঞ্জ দিয়ে বের হয়ে যায়। অন্যদিকে বিকাল ৫টার দিকে নগরের আন্দরকিল্লায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
রাবি প্রতিনিধি জানান, সমন্বয়কদের জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করাসহ ৯ দফা দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বিক্ষোভ ও অবরোধ করা হয়েছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এ কর্মসূচি পালন করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের সমন্বয়ক মেহেদী সজিব বলেন, পুলিশের গুলি জনগণের টাকায় কেনা, অথচ সেই গুলি তারা জনগণের ওপর চালায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যা করেছে। সমন্বয়কদের জোর করে তুলে নিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এসব ঘটনা ছাত্রসমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব ও আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতেখার আলম মাসুদসহ আরও অনেকে।
নিজস্ব প্রতিবেদক বরিশাল জানান, নগরীতে বিক্ষোভ ও গ্রাফিতি অংকন কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১২টায় নগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বরিশাল মহানগর পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় আধা ঘণ্টা অবস্থান নিয়েছিল। পরে তারা নিজেরা চলে গেছে। এ ছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় সভায় হামলার অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় এ হামলায় আন্দোলনের ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে সমন্বয়কারী সুজয় বিশ্বাস শুভ জানিয়েছেন। তবে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া আল সামাদ শান্ত জানিয়েছেন, কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছে। এতে ছাত্রলীগের তিনজন আহত হয়েছেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক সিলেট জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ‘জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে বিবৃতি আদায়ের’ অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে এবং গুম-গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও ছাত্র-জনতা হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এই কর্মসূচি চলে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শাবিপ্রবি, সিলেট’ ব্যানারে এই কর্মসূচিতে সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীতে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত জেলা শহর মাইজদী প্রধান সড়কের জিলা স্কুলের সামনে সড়কে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে এবং পথচারীদের যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সড়কের দুই পাশে অধিকাংশ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। পরে জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানের হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি শেষ করেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক যশোর জানান, যশোরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যশোরের সমন্বয়কারী দাবি করা চার শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
কালেক্টরেট ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। বিকাল ৪টার দিকে শহরতলির ধর্মতলা এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের দিকে আসার চেষ্টা করলে কারবালা এলাকায় পুলিশ তাদের বাধা দেয়।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, গতকাল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মসূচিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও জেলার একাধিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে থেকে মিছিল বের করে নবাব ফয়জুন্নেছা হল, প্রক্টরের বাসভবনের সামনে ঘুরে আবারো বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে ফিরে আসেন। এরপর শিক্ষার্থীরা ১৫ জুলাইকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
প্রত্যাহার : কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যশোর ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যশোরের সমন্বয়কারী দাবি করা চার শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলন করে এ আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। গতকাল দুপুর ২টার সময় যশোর পৌর কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে যে চার শিক্ষার্থী কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তারা হলেন- পরশ আহমেদ, ফাহিম আহমেদ, ইয়াসির আরাফাত ও মাহফুজ আলী। তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের যে দাবি ছিল তা পূরণ হওয়ায় কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই। একইভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে একটি বিবৃতিতে সই করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে উপাচার্যের সভাকক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কোটা সংস্কার আন্দোলন সংক্রান্ত কর্মসূচি প্রত্যাহার ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়। এতে ৯ শিক্ষার্থীর একটি দল অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রতিনিধিত্বকারীরা হলেন- আইন বিভাগের শিক্ষার্থী এনামুল হক, ইংরেজি বিভাগের আবদুুর রহমান, ইশতিয়াক আহমেদ, ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আল যুবাইর তামিম, অর্থনীতি বিভাগের তন্ময় কুমার সাহা, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এস বি বাধন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আরাফাত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের জুবায়ের এবং সমাজকল্যাণ বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ। বৈঠক শেষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষরিত দুই পৃষ্ঠার প্রেস বিবৃতি গণমাধ্যম কর্মীদের দেওয়া হয়। বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া, ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ উপস্থিত ছিলেন।