পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন নয়াদিল্লি অবস্থান করছেন। তার পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হবে, সেটা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। এদিকে যুক্তরাজ্যে তার রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে জটিলতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে বাতিল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও। গত সোমবার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগী এই সাবেক স্বৈরশাসক শেষ পর্যন্ত কোথায় থিতু হচ্ছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গতকাল নয়াদিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা আপাতত দিল্লিতে রয়েছেন। তিনি জরুরি ভিত্তিতে ভারতে সাময়িক আশ্রয় চেয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সেই কারণে আপাতত ভারত সরকার তাকে কিছুটা সময় দিয়েছে। এরপর তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, ভারতকে জানাবেন শেখ হাসিনা। সেই অনুযায়ী, ভারত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
সোমবার দুপুরে দেশ ছেড়ে পালানোর পর ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। সেখান থেকে যান নয়াদিল্লি। দিল্লি পৌঁছানোর পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি অবস্থান নিয়ে ভারতেও চলছে জোর আলোচনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গতকাল বাংলাদেশের ঘটমান পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন রাজ্যসভা ও লোকসভায়। বিবৃতিতে বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর ভারত আসার অনুরোধ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকা ত্যাগ করেন। পরে সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে আসেন। বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তাকে এখানে সাময়িক থাকতে দেওয়া হচ্ছে।
এর আগে এস জয়শঙ্কর সব রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে রাহুল গান্ধী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি নেওয়ার পরামর্শ দেন। জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সর্বদল সম্মতি রয়েছে। এই স্পর্শকাতর সময়ে আমাদের একমত নিয়ে চলতে হবে। বাংলাদেশের চলমান হিংসা ও অস্থিরতা নিয়ে সবার উদ্বেগের বিষয় অবহিত করতে চাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জানুয়ারি মাসের সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই উত্তেজনা ও গভীর বিভক্ত সমাজে মেরুকরণ হয়েছিল। এর প্রেক্ষাপটে জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে। সহিংসতা করে সরকারি সম্পত্তি, পরিবহন নষ্ট করা হয়। চলতে থাকে মাসজুড়ে। তিনি আরও বলেন, আমরা সব পক্ষকে সংযম রেখে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। ওখানে যেসব রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের সবাইকে বলা হয়েছিল। জয়শঙ্কর বলেন, ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর কিছু সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ পরিস্থিতি খারাপ করে তোলে। তারপর আন্দোলন রূপান্তরিত হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে। তিনি আরও বলেন, ৪ আগস্ট থেকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। সরকারি সম্পত্তি ছাড়াও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। তাদের সম্পত্তি নষ্ট করা হয়েছে। মন্দির ভাঙা হয়েছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আসেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে ঢাকায় জমায়েত হয়। আমাদের ধারণা, জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করার পর হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তারপর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আমাদের জানান হাসিনার দিল্লি সফরের কথা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ১৯ হাজার ভারতীয় আছেন। তার মধ্যে ৯ হাজার শিক্ষার্থী। ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ রেখে চলেছি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভারতে ফিরে এসেছেন। আশা করছি দ্রুত অবস্থা স্বাভাবিক হবে। ওখানকার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নজর রেখে চলছি। সীমান্ত প্রহরা বাড়ানো হয়েছে। নতুন সরকারের অপেক্ষায় রয়েছি।
এদিকে গতকাল প্রকাশিত ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, হাসিনা যুক্তরাজ্যে যাবেন এবং সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেবেন। তবে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, তাদের যে অভিবাসন আইন রয়েছে; সেখানে কোনো ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করে এসে রাজনৈতিক বা সাধারণ আশ্রয় নেওয়ার বিধান নেই। এর বদলে শেখ হাসিনাকে এখন ভারতেই আশ্রয় নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। এই মুখপাত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছেন; তিনি প্রথম নিরাপদ যে দেশে পৌঁছান সেখানেই আশ্রয় চাওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যাদের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রয়োজন তারা প্রথম যে নিরাপদ দেশে যান সেখানেই এটি চাওয়া উচিত। এটি নিরাপত্তার সবচেয়ে ভালো পথ।’ তবে যুক্তরাজ্যের অনীহা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা দেশটির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আবেদন করতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক। এ ছাড়া রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের আইনসভার সদস্য। যা হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টিকে সহায়তা করবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বাতিল হয়েছে শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা।