পতিত স্বৈরাচার শাসনামলে দেশের শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটে পরস্পরের সাথি ছিলেন সালমান এফ রহমান, লোটাস কামাল, শিবলী রুবাইয়াত ও আবুল খায়ের হিরু। শেয়ার কারসাজি করে এই সিন্ডিকেট পুরো শেয়ারবাজারকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। নানা অভিযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি সালমান-লোটাস কামাল, শিবলী-হিরু জোটের কাউকে। এতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এই দুই জুটি। শেয়ারবাজারে সর্বনাশের পেছনে রয়েছে দুই জুটির কারসাজি। নিয়মকানুন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলে তাদের অবাধ লুটপাট। এ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিঃস¦ হয়েছেন শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। লোপাট করে নেওয়া হয়েছে তাদের পুঁজি। লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে গেছে সালমান-লোটাস কামাল, শিবলী-হিরু গং। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালে যখনই শেয়ার কারসাজি ও জাল-জালিয়াতির কথা উঠেছে তখনই ঘুরে-ফিরে সামনে চলে এসেছে এসব নাম। তারা বাজার কারসাজিতে সহায়তা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদগুলোতে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়েছেন। এ চক্র একসঙ্গে মিলেমিশে শেয়ারবাজার থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ওই সময় বাজার থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে এক ব্যবসায়ীর নামে। শাইনপুকুর হোল্ডিংস নামে একটি কোম্পানির কাগুজে শেয়ার দেখিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়। যা ছিল পুরোপুরি ভুয়া শেয়ার সার্টিফিকেট। পরে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের সুপারিশে যার নাম উঠে আসে তিনি হলেন বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। যতবার শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা এই সালমান রহমানের নাম উঠে এসেছে সবার আগে। ২০১০ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ শেয়ার জালিয়াতির ঘটনায়ও এ ব্যক্তির নাম ছিল সবার মুখে মুখে। ২০১০ সালের এই কারসাজিতে নতুন জুটি হিসেবে তার সঙ্গে নাম যোগ হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের। লোটাস কামাল নামে পরিচিত এই ব্যক্তি পরে অর্থমন্ত্রী হন। সে সময় শেয়ার কারসাজিতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা সালমান-লোটাস কামালের পকেটে গেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে জানা যায়। লোটাস কামাল শেয়ার জালিয়াতি করে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের পর নিজে আর সরাসরি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও পর্দার অন্তরালে জালিয়াতির কলকাঠি ছিল লোটাস কামালের হাতেই। তার বুদ্ধি পরামর্শ ও নেপথ্য সহযোগিতায় শেয়ারবাজারে একের পর এক কারসাজি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ২০১০ সালের ওই কেলেঙ্কারির পর কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্তে সালমান এফ রহমান ও লোটাস কামালের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। সুপারিশ করা হয় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হওয়ায় এ দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। পুরো শেয়ারবাজার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেন তারা। শেয়ারবাজারে তাদের পছন্দই ছিল শেষ কথা। নিজেদের কারসাজি চলমান রাখতে পছন্দের ব্যক্তিকে বানাতেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ও কমিশনার। তাদের মনোনীত কর্মকর্তারা কে কোন বিভাগে দায়িত্ব পালন করবেন সেসব ঠিক করে দিতেন তারা।
২০১৯ সালে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজার কারসাজিতে নতুন গতি পায়। তার হাত ধরে বাজারে সক্রিয় ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আরেকটি নাম। সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ৩১ বিসিএসের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু। হিরু নাম ছাপিয়ে বাজারে পরিচিতি পায় ‘হিরো’ হিসেবে। হিরো ওলটপালট করে দেন শেয়াবাজারকে। এবার মূল খেলোয়াড় হন সালমান-লোটাস কামাল, শিবলী-হিরু চারজনের এই জোট। সালমান ও লোটাস কামাল এবং শিবলী-হিরু এ দুই জুটি শেয়ারবাজারে নানা কারসাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের আয়োজন করে। হিরু মধ্য স্তরের সরকারি চাকরিজীবী হয়ে তিন বছরের মধ্যে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনে যান। তিনি নানা প্রলোভন দিয়ে বাজারে নিয়ে আসেন সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, সম্পদশালী ব্যক্তি, ব্যাংকের মালিকসহ নানা পেশার মানুষকে। অনেককে কারসাজির অংশীদার করে মুনাফা দেন। আবার কাউকে কাউকে পথে বসিয়ে দেন।
শেয়ারজারের ধারাবাহিক অস্থিরতা এবং এর প্রতিকার নিয়ে গত মে মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই প্রতিবেদনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নাম উঠে আসে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএসইসির পদত্যাগী চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ও আবুল খায়ের হিরুসহ কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার নাম ছিল ওই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন লঙ্ঘন করে সালমান এফ রহমানকে বন্ডের অনুমোদন দেওয়ায় দ্বিতীয়বার বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নিয়োগ পান শিবলী রুবাইয়াত। প্রতিবেদনে আবুল খায়ের হিরু, তার প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাদবর, আলোচিত কারসাজিকারী আবদুল কাইয়ুম, হিরুর প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংস, ক্রিকেটার ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান, বহুল বিতর্কিত ও যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকা নিষিদ্ধ ব্যবসায়ী জাবেদ এ মতিন এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট সায়েদুর রহমানের নাম উঠে আসে। এতে বলা হয়, বাজারে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ড ছেড়ে সালমান এফ রহমান ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। এক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ১০০ টাকা দরে ওই বন্ড কিনতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের প্রাথমিক দাম ১০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সালমান। এতে সহায়তা করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সম্মতি না দিলেও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ও তার চক্রটি অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে শেয়ার মার্কেটে দুর্বল কোম্পানি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড, এশিয়াটিক ল্যাবসহ বিভিন্ন দুর্বল কোম্পানির আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন দেয়। এ প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে সহায়তা করেন শিবলী। এর ফলে মার্কেটে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়ে ধারাবাহিক পতন শুরু হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেয়ার মার্কেটে দুর্বল আইপিও অনুমোদন দিলে বিপুল অঙ্কের টাকা মার্কেট থেকে চলে যায়। এরপর সেকেন্ডারি মার্কেটে কারসাজি চক্রের তান্ডবে ধারাবাহিক পতন হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ ছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার জিরো কুপন বন্ড অনুমোদন দেন শিবলী রুবাইয়াত। এরপর বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে শিবলী রুবাইয়াতের পুনর্নিয়োগে সরাসরি সহায়তা করেন সালমান এফ রহমান। এরা অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে বন্ধ কোম্পানি চালু করার নামে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নিজস্ব লোকদের নতুন পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়ে বেশকিছু কোম্পানি দখল করেন। এর মধ্যে এমারেল্ড অয়েলের পর্ষদ ভেঙে মিনোরি বাংলাদেশকে মালিকানা দিয়ে শেয়ার কারসাজি করে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
বিগত বছরগুলোতে পুঁজিবাজারে কারসাজির ক্ষেত্রে আলোচিত নাম হয়ে ওঠে আবুল খায়ের হিরু। রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী হিসেবে সরকার থেকে তিনি বছরে বেতন-ভাতা পান সাকুল্যে ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। গত বছরের জুনের শেষে তিনি যে আয়কর নথি জমা দিয়েছেন, তাতে উল্লেখ করেছেন- ওই অর্থবছর শেষে তার নিট সম্পদমূল্য ২০ কোটি ২১ লাখ টাকা ছিল, যা আগের বছর ছিল ৬৫ লাখ টাকারও কম। অর্থাৎ এক বছর ব্যবধানে তার সাড়ে ১৯ কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে। সরকারি এই কর্মকর্তার স্ত্রী কাজী সাহিদা হাসান (তখন গৃহিণী) ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে শেয়ারবাজার থেকে আয় করেছেন ৫০ কোটি টাকারও বেশি। তার বৃদ্ধ বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মাতবরের ওই সময়ের আয় ২০ কোটি টাকারও বেশি। আর ছোট বোন কনিকা আফরোজ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তারও ওই বছরে আয় পৌনে ১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পুরো পরিবারের আয় প্রায় ১০৬ কোটি টাকা। এই আয়ের সবটা মিলে তার পরিবারের মোট সম্পদমূল্য ২৭৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ছাড়ায়, যা ২০১৯ সালের শেষেও ছিল মাত্র ২ কোটি টাকা। হিরু শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এই কারসাজির অভিযোগ তদন্তে বিএসইসি প্রমাণ পাওয়ার পর নামমাত্র জরিমানার মাধ্যমে তার সব অবৈধ আয়ের বৈধতা দিয়েছে শিবলী রুবাইয়াতের কমিশন। জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ারবাজারে যেভাবে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে এর দায় রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার। তারা এসব লুটপাটকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। একটি শক্তিশালী শেয়ারবাজার গড়ে তুলতে হলে শক্তভাবে অনিয়মে জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কেউ জালিয়াতি অনিয়ম করার সাহস যেন না পায় সেই পদক্ষেপ নিতে হবে এ সরকারকে। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১০ সালে কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ সুযোগে কারসাজি চক্র হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছে। গত ১৫ বছর বিএসইসি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ২০০৯-১০ সালে পুঁজিবাজারের পতনের পর লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যান। শেয়ার ক্রয়ে মার্জিন ঋণ প্রদানকারী বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। এই লুটপাটে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত।