রাষ্ট্র পরিচালনায় হার্ডলাইন নিয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে দুর্নীতির মূলোৎপাটনের। একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি, আইন, বিচার ও নির্বাহী- এই তিন বিভাগের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ব্যবসাবাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিল্প-কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পাশাপাশি বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারেও নজর রয়েছে সরকারের। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর উপদেষ্টা পরিষদকে এ সরকারের লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের যে সুযোগ এসেছে, তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রধান উপদেষ্টার এই বার্তা একইভাবে সরকারের সচিব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার তার অগ্রাধিকারের মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা, দুর্নীতি নির্মূল, সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের ওপর। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান। শুরুতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে পুলিশের সাবেক দুই মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহিদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে। এই গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, দুর্নীতি, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। শুধু তাই নয়, বিশেষ অভিযানের শুরুতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জুয়েলারি শিল্পের মাফিয়া ও স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেটের হোতা দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে। এই গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে জুয়েলারি শিল্প সিন্ডিকেটমুক্ত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুধু জুয়েলারি শিল্প নয়, দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের সব খাতকেই সিন্ডিকেটমুক্ত করার লক্ষ্য গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এই সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। উপরন্তু শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা নিরসনে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি আর্থিক খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাতে লুটপাটের পাশাপাশি যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে, তা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরি করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে ব্যাংক কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এরই মধ্যে লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট (বিএফআইউি)-সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দেশগুলোর সরকারের সহায়তাও চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, যুক্তরাজ্য ছাড়াও যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে প্রধান উপদেষ্টা উদ্যোগ নিয়েছেন।
আর্থিক খাতের পাশাপাশি প্রশাসনিক খাতেও সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগ এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সংস্কারের লক্ষ্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বৈঠক করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এই সংস্কার কার্যক্রম যে চলমান রাখতে হবে, জনগণের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে- সেই বার্তার এটিই হচ্ছে মূল কথা।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সূত্রগুলো জানায়, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নিতে রাজনৈতিক দল ছাড়াও ব্যবসায়ী, সম্পাদক, এনজিও সংগঠক, নারী নেতৃত্ব, সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বৈঠক করেছেন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের বিষয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আকক্সক্ষা এবং প্রত্যাশার ধরনটি উপলব্ধি করেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৮ আগস্ট বঙ্গবভনে উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তাঁর বয়স এরই মধ্যে প্রায় চার সপ্তাহ হয়ে গেছে। ফলে সরকারের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয়েছে। এখন কাজ দেখানোর পালা। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রশাসন যন্ত্রকে শক্তভাবে (হার্ডলাইনে) সেই কাজ শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, এটা আমাদের জন্য একটা মস্ত বড় সুযোগ। দেশটাকে মেরামত করার জন্য এটি লাইফ টাইম অপরচুনিটি। এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে।