বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ভয়াবহ পতনের মাধ্যমে যে বিজয় এসেছে ‘এটি আংশিক বিজয়’। বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। দীর্ঘ ১৬ বছর ভয়ানক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরা এতে একবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে, সেটি ভাববার কোনো অবকাশ নেই। তিনি বলেন, দৃশ্যমান শত্রুকে চেনা যায় এবং সহজেই মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু অজ্ঞাত বা অজানা শত্রুকে মোকাবিলা করাটা যথেষ্ট কঠিন। এই অজ্ঞাত-অজানা শত্রুর ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় রাজপথে থাকা সব রাজনৈতিক দলকে সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও সর্বদা সতর্ক ও সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান তিনি। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির এই নীতি-নির্ধারক আরও বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নৃশংস গণহত্যাসহ পতিত সরকারের বিগত ১৬ বছরের দুঃশাসনামলে হত্যা, অপহরণ, গুমসহ যত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, সমস্ত অপরাধের বিচার করতে হবে। এমন বিচার করতে হবে যাতে সব পক্ষই ন্যায়বিচার পায়। আমাদের নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির লাখ লাখ নেতা-কর্মীর প্রতি মিথ্যা-গায়েবি মামলা দিয়ে সাজানো রায় প্রদানের মাধ্যমে যে অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে, আমরা চাই না আর কারও প্রতি সেই অন্যায়-অবিচার করা হোক। অর্থাৎ বিচারটা যেন প্রকৃত অর্থেই ন্যায়বিচার হয়। এক প্রশ্নের জবাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বিএনপির রাজনীতিতে আসা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় নেতা-কর্মীসহ সবার প্রতি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময়ের নিপীড়িত-নির্যাতিত অনেকে সন্তানহারা, বাবাহারা, স্ত্রীহারা, ভাই বা বোনহারা। আবার অনেকে ব্যবসাবাণিজ্য, ঘরবাড়ি হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তাদের ক্ষোভ যন্ত্রণা অসহনীয়। লাখ লাখ নেতা-কর্মী এখনো কোর্টে হাজিরা দিচ্ছেন। আমি নিজেও আদালতে গিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছি। তার পরও তাদের সবার প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান- অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় আমাদের অর্জিত হবেই। ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এখন প্রধান করণীয় বিষয় কী?’ এমন প্রশ্নের জবাবে বর্ষিয়ান এই রাজনীতিক বলেন, পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকার গত ১৬ বছরে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তারা নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকারকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে সব প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন এবং শতভাগ পেশাদারিত্ব বজায় থাকে। এখন এটা সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকার কী ধরনের সংস্কার, পুনর্গঠন কিংবা পুনর্নিয়োগ করবে, সে প্রক্রিয়াটা সরকারই নির্ধারণ করবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং দেশের অর্থনীতিসহ সামগ্রিক বিষয়ে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাটাই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ দীর্ঘদিনের এই প্রশাসনে যারা ছিলেন- তারা বিগত সরকারের ন্যায়-অন্যায়ের সহযোগী। এদের পেশাদারিত্বে ফেরত না আনতে পারলে এই সরকারের যে কোনো উদ্যোগই বাধাগ্রস্ত হবে। বর্তমানে যে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, সেটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাত, আইনশৃঙ্খলাসহ প্রয়োজনীয় খাত পুনর্গঠনে সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে জনগণ অপেক্ষা করবে এবং তাদের সহযোগিতা করবে। তিনি আরও বলেন, বিগত ১৬-১৭ বছর ধরে যেসব রাজনৈতিক দল ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাজপথে আন্দোলন করেছে, তাদের সহযোগিতাও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর এই সহযোগিতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি দেশের জনগণ এবং ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রত্যাশা করে। সুতরাং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে কাজটি সম্পাদন করলে সরকারের সব উদ্যোগই সফল হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই সহজ হবে। ‘ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তার দেশের সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখার কথা বলেছেন’, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তার দেশের সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখতে বলেছেন। এটাই তার রাখার কথা। কিন্তু এর আড়ালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা? সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ভাবনা, প্রত্যাশা এবং তাদের সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণের চিন্তাভাবনা ও আশা-আকাক্সক্ষা এক ও অভিন্ন। তাই সার্বিক অর্থে গণতন্ত্র উদ্ধার ও মাফিয়াচক্রের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ যেমন জরুরি, তেমনি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরি। আয়নাঘর থেকে দীর্ঘদিন পরে কেউ কেউ ফিরে এসে আলোর মুখ দেখলেও, এখনো যাদের খোঁজ মেলেনি তাদের সন্ধান জানা নেই, এসব বিষয়গুলোর সমাধান করতে হবে। এ ছাড়া ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ইতিহাসের জঘন্যতম বিডিআর হত্যাকান্ডে সামরিক বাহিনীর চৌকস ৫৬ জন অফিসার ও ১৬ জন কমান্ডারসহ মোট ৭৪ জনকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং অসংখ্য বিডিআর সদস্যকে বিচারের নামে মৃত্যুদ ও কারারুদ্ধ করার যে অন্যায় রায় দেওয়া হয়েছে, জরুরিভিত্তিতে এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত করে ন্যায়বিচার করাটা জনগণের প্রত্যাশা। সবশেষে তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটি খুলে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস ও পরীক্ষাসমূহ অবিলম্বে শুরু করার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাটাও সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।