আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নেমে আসা বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে চিন্তাভাবনায় পড়েছে ১৪ দলের শরিক দলগুলো। তারা বলছে, আওয়ামী লীগ যে অন্যায়-অপকর্ম করেছে তার দায়ভার তাদেরই বহন করতে হবে। কোনোভাবেই শরিকরা এর দায় নেবে না। জোটে থেকে ‘মধু’ খেলেও আওয়ামী লীগের দায় নিতে নারাজ তারা। ১৪ দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব পাওয়া গেছে। নবম সংসদ নির্বাচনের পর জোটের কারণে ন্যাপ নেত্রী আমিনা আহমেদকে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি করা হয়। সংসদ নির্বাচনে সরাসরি আসন দাবি করলেও আওয়ামী লীগ ছাড় দেয়নি। এ প্রসঙ্গে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জোটে ছিলাম সত্য, কিন্তু সেটা ছিল নিবন্ধন টেকানোর জন্য। দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে আমরা যাইনি। কাজেই আওয়ামী লীগের অপকর্মের দায় কেন আমরা নিতে যাব। এর দায়ভার আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে।’ চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট করে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া পান ৫১১ ভোট। ২০০৪ সালে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হলে সাম্যবাদী দল সে জোটে যোগদান করে। এরপর আর তিনি ভোট করেননি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ভোটের পর মহাজোট সরকারে টেকনোক্র্যাট কোঠায় শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান দিলীপ বড়ুয়া। সারা জীবন নীতি নৈতিকতার কথা বললেও মন্ত্রী থাকা অবস্থায় নিয়েছেন নিজের ও সন্তানদের নামে কয়েকটি প্লট। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও আওয়ামী লীগের কাছে কাকুতি জানিয়েছিলেন জীবনে কোনোদিন জনপ্রতিনিধি হতে পারেননি, নৌকা নিয়ে জনপ্রতিনিধি হতে চান। কিন্তু ভোটের বাস্তবতায় ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন দিলীপ বড়ুয়া। এখন আওয়ামী লীগের কোনো দায় নিতে নারাজ দিলীপ বড়ুয়াসহ তাঁর দল। এ প্রসঙ্গে দিলীপ বড়ুয়ার মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একজন নেতা জানিয়েছেন, ‘আওয়ামী লীগ শরিকদের শক্তি সঞ্চার করতে বলেছিল। ২০১৮ সালের ভোটের পর থেকে তারা শরিকদের কোনো গুরুত্ব দেয়নি। যে কারণে আওয়ামী লীগ বার বার ভুল করেছে। যারা ভুল করেছে, অন্যায় করেছে, তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আমরা কোনো দায় নেব না।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু দুই দফা মন্ত্রী হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আসন থেকে কয়েক দফা এমপিও হয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইনু স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদ প্রধান হাসানুল হক ইনু বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শরিক হওয়ার কারণেই আমাদের দলের ওপর খড়গ নেমেছে। আমরা কেন আওয়ামী লীগের ভুক্তভোগী হব। দায়ভার কেন বহন করব’। স্থায়ী কমিটির ওই সদস্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন দলটির দপ্তর সম্পাদক মো. সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুলত্রুটি থাকতে পারে। সেখানেই দেশের প্রচলিত আইন রয়েছে। দোষী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা উচিত। এ জন্য সাংবিধানিক যে অধিকার রয়েছে, তা যেন লঙ্ঘিত না হয়।’ প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও জোটের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের দুর্নীতি-লুটপাটসহ অতীত কর্মকান্ডের দায় শরিক দলগুলোর ওপর চাপানো মোটেই ঠিক হবে না। শরিকদের অনেকেই মন্ত্রিসভায় ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেটার বিচার হতে পারে। কিন্তু শরিক হিসেবে আওয়ামী লীগের দায় তাদের ওপর চাপানো মোটেও ঠিক নয়। কারণ একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বড্ড অহংকারী হয়ে পড়েছিল। জোটে রাখলেও কাউকে যোগ্য মূল্যায়ন করেনি। এ ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শরিক দলগুলোর পক্ষে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরামর্শ দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। যে কারণে বর্তমান অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এককভাবে দায়ী। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়। ২০০৮ সাল, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও জোটগতভাবে ভোট করা হয়। নবম সংসদের শুরুর দিকে একজন এবং শেষের দিকে জোটের দুই নেতাকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়। দশম সংসদেও তা বহাল থাকে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা জোটের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এতে আওয়ামী লীগের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। কুষ্টিয়া থেকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু হেরে যান। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মামলা হয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশাসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে। হেভিওয়েটদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইনু-মেনন। তাদের কয়েক দফায় রিমান্ডও হয়েছে। এখন তারা কারাভোগ করছেন। মঞ্জুকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাকে পরে জামিন দেওয়া হয় শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ হওয়ায়। সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের নামে মামলা দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। জোটের শরিক দলগুলোর সাবেক এমপি ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের নামেও মামলা হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির অন্তত ১০ জন, জাসদের নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে দল দুটি থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। এ দুই দলের নেতারা জানিয়েছেন, তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে মামলার আতঙ্কে রয়েছেন। কার বিরুদ্ধে কখন মামলা হয়, কোন মামলা হয়- এগুলো নিয়ে তারা ভয় পাচ্ছেন।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        