পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনমুখী বিএনপির তিন সংগঠনের গতকালের পদযাত্রা পুলিশের বাধার মুখে নয়াপল্টন থেকে রামপুরা এসে থেমে যায়। পরে তিন সংগঠনের পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল হাইকমিশনে গিয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও উসকানিমূলক অপপ্রচারের প্রতিবাদে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে প্রতিবাদী পদযাত্রা ও স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচিতে অংশ নেয় বিএনপির তিন সংগঠন- জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। এরই অংশ হিসেবে গতকাল সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন সংগঠন তিনটির নেতা-কর্মীরা। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ আয়োজক সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। এ সময় রিজভী বলেন, ‘আমরা অবলম্বনহীন নই, আমরাও সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে জানি। দেশকে রক্ষা করার জন্য আকাশ, পাতাল, ভূমি, পানি প্রতিটি জায়গায় আমাদের যে শক্তি আছে, তা দিয়ে দিল্লির আগ্রাসন প্রতিহত করতে প্রত্যেকে প্রস্তুত রয়েছি।’ সমবেশ শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নয়াপল্টন থেকে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে প্রতিবাদী পদযাত্রা শুরু করেন তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পদযাত্রা রামপুরা ব্রিজের কাছে এলে পুলিশ নেতা-কর্মীদের সেখানে আটকে দেয়।
সরেজমিন দেখা যায়, আগে থেকেই পুলিশ রামপুরা ব্রিজের ওপর অবস্থান নিয়ে সেখানে ব্যারিকেড বসায়। পরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা স্মারকলিপি নিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের দিকে যান। পদযাত্রা করে নয়াপল্টন থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। নয়াপল্টন থেকে কাকরাইল, মৌচাক ও মালিবাগ হয়ে পদযাত্রা রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত আসে। এ সময় এ পথে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় বের হওয়া সাধারণ লোকজন ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েন। ভারতীয় দূতাবাসে স্মারকলিপি জমা দেন ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী, যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নয়ন ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন।
এদিকে, নয়াপল্টনে পদযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে রুহুল কবির রিজভী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘নানা অপপ্রচার-অপতথ্য দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কলকাতার নিউমার্কেট বন্ধ। কলকাতার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বন্ধ। কলকাতার হাসপাতালে রোগী নেই। ক্লিনিকগুলো বন্ধ। তাতে আপনাদের আনন্দ হতে পারে, কিন্তু আমাদের এখানে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।’ ভারত ভয়ংকর রকমের সাম্প্রদায়িক দেশ উল্লেখ করে রিজভী বলেন, ঘৃণা দেখানো ছাড়া, ভিন্নধর্মের প্রতি প্রতিহিংসা দেখানো ছাড়া ওদের আর কোনো রাজনীতি নেই। ওদের রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে।
রিজভী আরও বলেন, ‘হাসিনা পলাতক, বাংলাদেশ থেকে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। দিল্লির আশীর্বাদে ১৫ থেকে ১৬ বছর তাঁকে টিকে থাকতে হয়েছে। উনি ভোট ধ্বংস করেছিলেন। ভোটারদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। উনি নির্বাচন শেষ করে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ধ্বংস করে দিয়েছেন।’ রিজভী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার নিজের দেশের জনগণ ভোট দিতে পারে, ইচ্ছেমতো সরকার পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যাকে সমর্থন করেন, সেই হাসিনা মানুষকে বন্দি ও ক্রীতদাস করে রেখেছিলেন। তাঁকে আপনারা সমর্থন করেন। তার মানে কি আপনারা বাংলাদেশের মানুষকে পছন্দ করেন না? আপনারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করেন না? স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করেন না? তাহলে হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছেন কেন?’
রিজভী আরও বলেন, জনগণের প্রবল ক্রোধে হাসিনা পালিয়ে গেলেন। সেই হাসিনাকে ফেরানোর জন্য ভারতের শাসকশ্রেণি যা করছে, এটা পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আগ্রাসন ছাড়া কিছু নয়। রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘হাসিনার জন্য এত মন খারাপ কেন? কারণ ভারতের সঙ্গে ভুটান নেই, নেপাল নেই, শ্রীলঙ্কা নেই, পাকিস্তান নেই, ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ তাদের সঙ্গে নেই। ওদের সঙ্গে কেউ বন্ধুত্ব করতে পারে না। কারণ ওরা মুখে যাই বলুক, ধর্মনিরপেক্ষ বলুক আর সেকুলার বলুক, ওদের মনে কট্টোর হিন্দুত্ববাদী ছাড়া আর কিছু নেই।’
সমাবেশে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, ‘ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করেছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, তারা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখেনি। তারা ন্যক্কারজনকভাবে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালিয়েছে, ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। তারা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। হাসিনাকে খুশি করতে অবন্ধুসুলভ আচরণ করছে।’
স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ কোনো আগ্রাসী মনোভব গ্রহণ করবে না। রাজপথে সোচ্চার থেকে প্রতিবাদ জনাবে। যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না বলেন, ‘আমরা বন্ধুরাষ্ট্র চাই। প্রভুসুলভ মনোভব চাই না। এমন মনোভব আমরা গ্রহণ করব না।’ সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন প্রমুখ।
স্মারকলিপিতে যা বলেছে বিএনপি : ভারতীয় হাইকমিশনে বিএনপির তিন সংগঠনের পক্ষে দেওয়া স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সাম্প্রতিক অবন্ধুসুলভ ঘটনাবলি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র-জনতার অভাবনীয় তুমুল আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা আপনার দেশে পালিয়ে যাওয়ার পর আপনারা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। অতঃপর আপনার দেশের অতি উগ্রবাদী নেতারা এবং বিশেষ করে কতিপয় সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়া বাংলাদেশের এই গণশত্রু হাসিনা ওয়াজেদকে পুনরায় পুনর্বাসন এবং বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অস্থিতিশীল করার নিমিত্তে একের পর এক অজ্ঞ-অর্বাচীনের ন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। যাতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের বন্ধুত্ব ছিল হাসিনার সঙ্গে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে নয়। হাসিনা এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠেছে। একদিকে তিনি বাংলাদেশের ভিন্ন দলমতের মানুষদের ঘরবাড়ি সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুকুম দিচ্ছেন। অপরদিকে যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাদেরকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছেন। ভারতের নিরাপদে আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার এই অপচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না।’ ‘এক্সিলেন্সি, আপনি সম্যক অবগত আছেন যে, গত ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হয়েছে। নৈতিক পদস্খলনের কারণে ইসকন থেকে বহিষ্কৃত সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হাজার হাজার মানুষ যখন রাষ্ট্রীয় মদত ও প্রশ্রয়ে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা করছিল তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে আপনার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’