প্রায় ২৩ বছর আগে রাজধানীতে মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত একমাত্র আসামি জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোছা. শাহীনুর আক্তারের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী আমিনুর রহমান আমিন বলেন, এই মামলাটি এর আগে সপ্তম অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। গত বছরের ২২ আগস্ট মামলাটি এই আদালতে আসে। এর পর ২৫ আগস্ট যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য হয়। কিন্তু সেদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় আজকের দিন ধার্য করেন আদালত। তিনি আরও বলেন, মামলায় আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযুক্ত আসামিকে আদালত খালাস দেন। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। মামলায় ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর আসামি শুরু থেকেই পলাতক। আদালতের পিপি সৈয়দ মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর বিশ্লেষণ করে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।
জানা যায়, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গার চীন মৈত্রী সেতুর নিচ থেকে তখনকার জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনশিল্পী তিন্নির লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার তখনকার এএসআই মো. সফি উদ্দিন। এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এসআই মো. কাইয়ুম আলী সরদার। পরে মামলাটিকে ‘চাঞ্চল্যকর মামলা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্ত যায় সিআইডিতে। তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক ফজলুর রহমান।
এর পর সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণের হাত ঘুরে তদন্তের দায়িত্ব পান এএসপি মোজাম্মেল হক। তিনি ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর গোলাম ফারুক অভিকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তাতে বলা হয়, সাবেক ছাত্রনেতা অভি ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ চাপা দিতে তিন্নিকে খুন করেন এবং লাশ ওই সেতুর নিচে ফেলে রাখেন। অভি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাকে ধরা সম্ভব হয়নি জানিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৯২ সালে রমনা থানায় দায়ের করা একটি অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়েছিল অভির। ওই মামলার রায়ের পর হাই কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে কানাডা চলে যান তিনি। অভিকে ধরার জন্য ২০০৭ সালে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি হয়েছিল, কিন্তু তাকে দেশে ফেরানো যায়নি। এতে আরও বলা হয়, মামলা হওয়ার পর পুলিশ সে সময় তিন্নির স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়াল, এবায়দুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী, গাজী শরিফউল্লাহ তপন, শফিকুল ইসলাম জুয়েল ও সোমনাথ সাহা বাপ্পীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু হত্যাকান্ডে তাদের কারও সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অবশ্য তাদের জবানবন্দিতেই হত্যাকান্ডে অভির সম্পৃক্ততা উঠে আসে। তিন্নির দুই গৃহপরিচারিকাও আদালতে জবানবন্দি দেন।
জানা যায়, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় গোলাম ফারুক অভি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অভি ‘অস্ত্রবাজ নেতা’ হিসেবে আলোচিত ছিলেন। ১৯৯০ সালের নভেম্বরে ডাক্তার মিলন নিহত হওয়ার পর আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই জানা যায়, তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন অভি। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বরিশাল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর তিনি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন। তার পরের বছরই খুন হন তিন্নি।
আভিযোগপত্রে বলা হয়, অভি ওই হত্যাকান্ডের আগে স্বামী পিয়ালের সঙ্গে তিন্নির দাম্পত্য সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে তাকে ‘ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক’ গড়ে তোলেন। কিন্তু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অভি তাকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দেননি, বরং বিয়ের জন্য তিন্নি চাপ দিলে ‘পরিকল্পিতভাবে’ তাকে খুন করে গড়িতে করে লাশ চীন-মৈত্রী সেতুর নিচে ফেলে রাখেন।
২০১০ সালের ১৪ জুলাই পলাতক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। পরের বছরগুলোতে অভিযোগপত্রভুক্ত ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী অভির পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে একজন আইনজীবীও নিযুক্ত করা হয় বলে জানা যায়।