জীবদ্দশায় একজন সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন এমন বিধান করার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। অপরদিকে, বিএনপি, এলডিপি ও এনডিএম এ প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেছে। বিএনপি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) ও জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আগামীতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের পঞ্চম দিনের সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ও সংসদের উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন, এনসিসি গঠনসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। এনসিপি ও ইসলামী দলগুলো সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের পক্ষে থাকলেও বামদলগুলো বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বহাল রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে দলগুলোকে নিজের মধ্যে আলোচনার জন্য দুই দিন সময় দিয়ে আগামী বুধবার সংলাপে বসবে ঐকমত্য কমিশন।
সংলাপ শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সারা দিন আলোচনায় আমরা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি, এ দুটি বিষয়ে বিস্তারিত কথাবার্তা বলেছি। দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমরা সুস্পষ্ট এক জায়গায় এসেছি। একজন ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এ রকম একটি জায়গায় আসার পর আমরা এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। আলোচনার পর তিনটি দল ভিন্নমত পোষণ করে তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে। তারা তাদের দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে আবার কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এ বিষয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিষয় যুক্ত-বিশেষ করে এনসিসি গঠন ও উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠন হবে, সেই বিষয়ে আলোচনার সময় তা উপস্থাপন করবেন।
আলী রীয়াজ বলেন, এখন পর্যন্ত আলোচনা করে যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল তিনটি দল বাদে সবাই এক জায়গায় পৌঁছেছে। আমরা আশাকরি, এ বিষয়ে সবাই একমত হতে পারবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতির বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আগামীতে বিভিন্ন দলের সেন্টিমেন্ট ও অবস্থান বিবেচনা করে ঐকমত্য কমিশন থেকে একটি প্রস্তাব হাজির করা হবে। এতে কী আলোচনা হয়েছে তার প্রতিফলন মিলবে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে আগামী দুই দিন বৈঠক মুলতবি করা হয়েছে। দলগুলো তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করতে চায়। আমরা আশা করছি এর মাধ্যমে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান আসবে।
এর আগে সংলাপের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আপনারা আসছেন, আরেকটু আগান। তাহলে জুলাই সনদ দ্রুত করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা এখানে এসেছি একটি বিশেষ ও কঠিন বাস্তবতায় ১৬ বছরের সংগ্রাম, সহস্রাধিক মানুষের আত্মত্যাগ, অনেকের নিখোঁজ হওয়া ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে। রাজনৈতিক দলগুলোরও অনেক ত্যাগ রয়েছে। তাই আসুন, সবাই মিলে সমঝোতার পথে এগিয়ে যাই।
সংলাপ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ যদি এখানে নির্ধারণ করা হয়, তবে তার সঙ্গে এনসিসির আলাপটা আনতে হবে। যদি উচ্চকক্ষের একটা জেনারেল বিল পাস হতে ৫০ শতাংশ মেজরিটি লাগবে। সংবিধান সংশোধনের কথা বলা আছে উচ্চকক্ষে। দুই তৃতীয়াংশের মেজরিটির মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষে সংবিধান সংশোধনের কথা বলা আছে। তখন কেউ দুই তৃতীয়াংশ পাবে না। সেই জিনিসগুলো একসঙ্গে আলোচনা হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রসঙ্গে আমরা আগেই বলেছি। এই বিষয়টা আজকে আসেনি, কিন্তু এটা রিলেটেড। যদি উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সদস্য সংখ্যা যদি ১০০ হয়, আর যদি নারী আসন ১০০ হয়, সংসদের নিম্নকক্ষ যদি ৩০০ হয়, তাহলে ৫০০ সদস্যের মধ্যে আমরা বলেছি গোপন কক্ষে ব্যালটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে পারে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কী হবে, না হবে, আইনে নির্ধারণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি আরও ক্ষমতা দেওয়া হয়।
সেই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়টা, সরকার পরিচালনার বিষয়টা সম্পৃক্ত। অন্তত এনসিসি উচ্চ কক্ষের বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সঙ্গে একই প্যাকেজে আলোচনা করে, একটা সিদ্ধান্তে এলে তখন সুবিধা হবে। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে আপনারা জানেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। এভাবে বলা আছে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আর্টিকেল ৮, ৯, ১০ ও ১২ উল্লেখ করা আছে। এখানে সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবে ছিল, এই আর্টিকেলগুলো বিলুপ্ত করা হবে। তার বিকল্প হিসেবে উনারা কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। আমাদের লিখিত প্রশ্ন এবং পরবর্তী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে, সিদ্ধান্ত না আলোচনা মধ্যে রয়েছে, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা, সুবিচার, গণতন্ত্র। এই চারটা সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করা যায় কিনা। এখন মূলনীতি নির্ধারণ করবে কীভাবে? এখানে যারা আলোচনা করছেন তারা অনেকে পঞ্চদশ সংশোধনীতে যেভাবে আছে তার পক্ষে। পঞ্চদশ সংশোধনী আমরা পুরোটাই বিলুপ্ত চেয়েছি। যার মধ্যে এই মূলনীতিগুলো আছে। আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বের অবস্থা বহাল চাই। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। আমরা এ বিষয়ে মত দিয়েছি। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই এ মতামতের পক্ষে। তবে দুই-তিনটি দল এর বিপক্ষে। তারা চান একজন একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
মুজিববাদী সংবিধানের চার মূলনীতির পুরোপুরি বাতিলের দাবি করেছেন বলে জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা। তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতির বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব ছিল, মূলনীতিগুলো বাতিল করা। তাঁরা পাঁচ মূলনীতির প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা চার মূলনীতি বাতিলের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছি। তিনি বলেন, আমরা একজন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন প্রস্তাব করেছিলাম। সেক্ষেত্রে এখন যদি একজন সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, এমন বিধান করা হলেও আমাদের আপত্তি নাই।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদে নানান ফাঁকিজুকি থাকতে পারে। সে বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে বেশির ভাগ দল একমত থাকলেও ‘স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীরা’ আপত্তি জানিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামদলগুলো এ চার মূলনীতি পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে কোনো ঐকমত্য হবে না বলেও জানান তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, একজন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার পক্ষে তার দলের অবস্থান। তবে টানা হতে পারবেন কিনা বা প্রথমবার বিরতি দিয়ে দ্বিতীয়বার হতে পারবেন কিনা এ নিয়ে কিছুটা দ্বিমত আছে। আশা করি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটিও ঠিক করা যাবে। তিনি আরও বলেন, সব বিষয়ে কেয়ামত পর্যন্ত একমত হওয়া সম্ভব নয়। তাই কমিশনের উচিত এ বিষয়ে একটি সীমা বেঁধে দেওয়া। কারণ, এভাবে দিনের পর দিন সিদ্ধান্তগুলো অমীমাংসিত থেকে যায়।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা পারস্পরিক আলোচনা করেছি। সেখানে বিশের ভাগ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, একজন সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তিনি মনে করেন, এতগুলো দল একসঙ্গে বসা অনন্য ঘটনা। এটি ইতিবাচক। তবে আরও বেশি একমত হলে ভালো হয়। আর পুরোপুরি একমত না হলেও সময় অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতির বিষয়গুলো আমরা পরিবর্তন চাই। একমত না হওয়াই এ বিষয়ে আলোচনা চলবে।