তারিক সিদ্দিক একসময় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ২০০১ সালে তাকে দুর্নীতি এবং নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা হয়। সেই সময় তিনি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। এ সময় তিনি প্রতিহিংসায় উন্মত্ত শুধু হননি, দুর্নীতির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যান। বিদেশে যেমন বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছেন, তেমনি দেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। যেহেতু তিনি সামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা, তাকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারত না। নিজেও থাকতেন লোকচক্ষুর আড়ালে। গত সাড়ে ১৫ বছরে তিনি মাত্র একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদপত্র ও মিডিয়াকে তিনি আড়াল করে রাখতেন। যেমন করে আড়াল করে রাখতেন তার অবৈধ সম্পদ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু বিদেশে নয়, দেশেও তিনি সম্পদের পাহাড় করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার অবৈধ সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার অবৈধ অর্থের উৎস সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, অবসরের সময় তারিক সিদ্দিকের সব স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫২ লাখ টাকার। এ সময় তার পৈতৃক সূত্রে বনানীতে একটি বাড়ির অংশ এবং ১ বিঘা জমি ছাড়া কোনো সম্পত্তি ছিল না। ২০০৯ সালে তারিক সিদ্দিক যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন তখন তার সব ব্যাংক মিলিয়ে আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা। নিয়ম অনুযায়ী যখন কেউ সরকারের কোনো পদে অধিষ্ঠিত হয়, তখন ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারেন না। সেই হিসেবে তারিক সিদ্দিকের একমাত্র উপার্জনের পথ ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে মন্ত্রীর পদমর্যাদার যে বেতন-ভাতা পেতেন সেটি। তাও আবার প্রথম মেয়াদে তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় বেতন-ভাতা পান। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে তার বেতন-ভাতার পরিমাণ ছিল মাসিক দেড় লাখ টাকা। তার স্ত্রীর নামে তথাকথিত কিছু নামসর্বস্ব ব্যবসা ছিল, যে ব্যবসাগুলো করা হতো আসলে দুর্নীতি এবং অনিয়মের জন্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণের জন্য। এ ছাড়া তারিক সিদ্দিক এবং তার স্ত্রীর কোনো বৈধ উপার্জন ছিল না। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তার সম্পদের হিসাব খোঁজ করতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তা হতবাক হয়ে গেছেন। তারিক সিদ্দিকের ৬২ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। একই সঙ্গে ১৬২ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায় তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানসহ তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাজীপুরের বাঙ্গালগাছ এলাকায় রয়েছে তারিক সিদ্দিকের ‘বাগান বিলাস’ নামে বিশাল বাগানবাড়ি। একইভাবে ফাওকাল এলাকায় ডুপ্লেক্স ভবনসহ বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তারিক সিদ্দিক। বিলাসে তার বাগানবাড়ি ছেড়ে রাজধানীর আভিজাত্য এলাকায় নজর দিলেও দেখা যায় তারিক সিদ্দিকের ফ্ল্যাট, প্লটের নানা ফিরিস্তি। বারিধারা আবাসিক এলাকায় পার্ক গলিতে তার ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। বারিধারা ডিওএইচএসে তিনি বানিয়েছেন সাত তলা বিশাল বাড়ি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, যে সম্পত্তিগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে তা তারিক সিদ্দিকের প্রকৃত সম্পদের তুলনায় অনেক কম। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে তদন্তে নিত্যনতুন সম্পদের তথ্য পাচ্ছে। ইতোমধ্যে গুলশানে তারিক সিদ্দিকের নামে তিনটি ফ্ল্যাটবাড়ি পাওয়া গেছে। যা তারিক সিদ্দিক তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- তার মায়ের আয়কর নথিতে এসব ফ্ল্যাটের কোনো অস্তিত্ব নেই।
পূর্বাচলের ৭ নম্বর সেক্টরে একটি প্লট রয়েছে তারিক সিদ্দিকের নামে। তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের নামে পূর্বাচল নতুন শহর সেক্টর ২১ ও ৩০-এ তিনটি প্লট রয়েছে। পূর্বাচলের ২৬ নম্বর সেক্টর রয়েছে ১০ কাঠার একটি এবং ৫ কাঠার আরও দুটি প্লট। বারিধারা মডেল টাউনে সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, বারিধারা ডিওএইচএসে প্রায় ৩ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার এফডিআরসহ ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশন আরও অনুসন্ধান করে দেখতে পায় তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের ৫২ বিঘা জমি রয়েছে গাজীপুরে। গাজীপুরে এসব জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
প্রশ্ন উঠেছে, যার সারা জীবনের উপার্জন ১ কোটি ১০ লাখ, ২৬ কোটি টাকা দিয়ে গাজীপুরে জমি কেনেন কেমন করে? এত সম্পদ তিনি করেন কীভাবে? গাজীপুরে জমির সন্ধান পাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালতে এ সম্পত্তি জব্দের আবেদন করেন এবং তার সম্পত্তি শেষ পর্যন্ত জব্দ করা হয়। গাজীপুরের জমি জব্দের আবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশন জানায় তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও শাহিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। জানা গেছে, তাদের মালিকানাধীন এসব সম্পত্তি অন্যত্র হস্তান্তর ও বেহাত করার চেষ্টা করছেন। এসব সম্পদ স্থানান্তর হয়ে গেলে অনুসন্ধানের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে তুলে ধরে দুদক বলেছে, অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন, স্থানান্তর বা অন্য কোনো প্রক্রিয়া হস্তান্তর করতে না পারে, সেজন্য সম্পদ জব্দের আদেশ চাওয়া হয় এবং আদালত সেই আদেশ মঞ্জুর করেন। কিন্তু এর মধ্যেই তারিক সিদ্দিক তার বেশ কিছু সম্পদ গোপনে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত তারিক সিদ্দিকের গাজীপুরের ফাওকালে সুরক্ষিত বাগানবাড়িতে ডুপ্লেক্স ভবন, বিশাল পুকুর এবং গাছপালা রয়েছে। টাঁকশালের পাশেই তার অন্তত ২২ বিঘা জমি আছে। কিন্তু নথিতে দেখানো আছে মাত্র ৫ বিঘা জমি। গাজীপুরের বাঙ্গালগাছ এলাকাতে তারিক সিদ্দিকের ভাই রফিক সিদ্দিকের নামে আরেকটি বাগানবাড়ি রয়েছে। এ বিশাল বাগানবাড়ি নথিতে ৭৮ শতাংশ হলেও বাস্তবে ১০ গুণের বেশি। রফিক সিদ্দিকের এ সম্পত্তি তারিক সিদ্দিকের বলেই একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। গাজীপুরের কালাইয়া ভূমি অফিসের তথ্যমতে, টিউলিপ টেরিটরি এর ২ একর ৬৬ শতাংশ জমির মালিক তার আরেক ভাই শফিক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি শেখ রেহানার স্বামী। তাদের মধ্যে সম্পর্ক না থাকলেও আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেনি। এ বাড়িটি গাজীপুর এলাকায় শেখ রেহানার বাড়ি নামে পরিচিত। এ বাড়িটি আসলে তারিক সিদ্দিকের কেনা। নিজের দুর্নীতি প্রশ্নহীন করতেই শেখ রেহানাকে তিনি এটি উৎকোচ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গাজীপুরে তারিক সিদ্দিকের বাগানবাড়ি আসলে দুটি। গুলশানে একটি সাত তলা বাড়ি, বসুন্ধরায় তিনটি প্লট, তারও স্ত্রীর নামে বারিধারায় ৪টি ফ্ল্যাট ও একটি ফ্ল্যাটের একাংশ, গাজীপুরে সাত তলা বাড়ির চার ভাগের এক ভাগ, এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জে তারিক সিদ্দিক দম্পতির রয়েছে ৪৮ বিঘা জমি। তবে এসব সম্পদের মধ্যে বেশ কিছু জমি গোপনে বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাজীপুরের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তারিক সিদ্দিক তার ভাই রফিক সিদ্দিকের স্ত্রীর এবং শফিক আহমেদ সিদ্দিকের একাধিক জমি বিক্রি করেছেন। এসব জমি কে, কীভাবে কিনেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। কিন্তু আইন অনুযায়ী জমি বিক্রির সময় দলিলে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। প্রশ্ন উঠেছে তারিক সিদ্দিক ৩ আগস্টে বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু ৩ আগস্ট যদি তিনি পালিয়ে যান তাহলে তিনি এ জমি বিক্রি করলেন কীভাবে?